অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মেয়েদের প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগার প্রবণতা ক্রমশ কমছে রাজ্যে। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলছে। কিন্তু দফতরের এই সাফল্যে স্বাস্থ্যকর্তাদের মুখে হাসি ফোটার বদলে এখন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। কী করে এমন উলটপুরাণ সম্ভব হল, তা নিয়ে সংশয় কাটাতে উল্টে তদন্তেরই নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন।
গোটা দেশে ‘র্যাপিড হাউসহোল্ড সার্ভে— ২০১০’ অনুযায়ী, অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন রক্তাল্পতায় ভোগেন ভারতের ৬৫.৬% মহিলা। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যাটা প্রায় ৬৪%। যদিও রাজ্য সরকারের তথ্য বলছে, বাম আমলের শেষ বছর ২০১০ সাল পর্যন্ত রাজ্যে প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগা (রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৭ গ্রামের কম) অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা ছিল ১২% থেকে ১২.৫%। কিন্তু ২০১১-র মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চে সেই সংখ্যা কমে ৭%-এ দাঁড়িয়েছে। এই পরিসংখ্যান হাতে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যায় স্বাস্থ্য ভবন। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “মাত্র এক বছরের মধ্যে এ রাজ্যে অন্তঃসত্ত্বাদের শারীরিক অবস্থা এতটাও ভাল হয়ে যায়নি যে প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগা অন্তঃসত্ত্বাদের সংখ্যাটা এত কমে যাবে!”
এই বিস্ময় থেকেই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা। গত ১৫ জুলাই প্রতিটি জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকদের (সিএমওএইচ) চিঠি লিখেছেন রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা। তাতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগা অন্তঃসত্ত্বাদের সংখ্যা কী করে কমে গেল সেটা তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে হবে। এর পাশাপাশি চিঠিতে নিজের মতামতও জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা। |
লিখেছেন, ‘উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যে ধাত্রীসহায়িকারা (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ বা এএনএম) রয়েছেন তাঁদের অনেকেরই ‘হিমোগ্লোবিন কালার স্কেল’-এ সঠিক ভাবে রক্ত পরীক্ষার দক্ষতা নেই। তাই তাঁরা বুঝতে পারেন না, অন্তঃসত্ত্বাদের মধ্যে কারা প্রবল রক্তাল্পতায় ভুগছেন। পরীক্ষা যথাযথ না-হওয়ায় ‘সিভিয়ারলি অ্যানিমিক প্রেগনেন্ট উওমেন’-এর সরকারি তালিকায় প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগা অন্তঃসত্ত্বাদের একটি বড় অংশের নামই থাকছে না।’ অর্থাৎ, সরকারি তালিকায় এই অংশটি নিখোঁজ থেকে যাচ্ছেন। এবং তার মতে, গত দু’বছরে এই কারণেই সরকারি পরিসংখ্যানে প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগা অন্তঃসত্ত্বাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাংশ কমে গিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিকর্তার অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ অনেক ধাত্রীসহায়িকা। তাঁদের বক্তব্য, হিমোগ্লোবিন কালার স্কেল-এ রক্তাল্পতা মাপা সহজ প্রক্রিয়া। এতে ভুল হওয়ার অবকাশই নেই। সহায়িকাদের দাবি মেনে কলকাতা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে হাওড়ার সাঁকরাইলে হাজি এসটি মল্লিক উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে হিমোগ্লোবিন কালার স্কেল-এ রক্ত পরীক্ষার পদ্ধতি হাতেকলমে দেখা গেল। সেখানে আঙুলের ডগায় সরু সূঁচ ফুটিয়ে অন্তঃসত্ত্বাদের রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কালার স্কেলে লাল রঙের বিভিন্ন ‘শেড’ করা রয়েছে। এক-একটি শেড মানে এক-এক রকম হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ। সংগৃহীত রক্ত স্কেলের কোন শেড-এ রয়েছে, তা দেখেই রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বুঝে নিচ্ছেন সহায়িকারা। তেমন কোনও জটিলতা নেই।
তবে কি সত্যিই এ রাজ্যে প্রবল রক্তাল্পতায় ভোগা অন্তঃসত্ত্বাদের সংখ্যা কমেছে?
হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদের মতো একাধিক জেলার বহু ধাত্রীসহায়িকা এই প্রশ্নের জবাবে বল ঠেলেছেন স্বাস্থ্য কর্তাদের কোর্টেই। তাঁদের অভিযোগ, “হিমোগ্লোবিন কালার স্কেল দেখতে যদি কোনও ধাত্রীসহায়িকার ভুল হয়, তার জন্য দায়ী স্বাস্থ্য দফতরই।” তাঁদের যুক্তি, “অনেক উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রায় ৫-৭ হাজার অন্তঃসত্ত্বা-সদ্যপ্রসূতি-নবজাতকদের দেখার জন্য ধাত্রীসহায়িকা রয়েছেন মাত্র দু’তিন জন। এক জন অন্তঃসত্ত্বার স্বাস্থ্যপরীক্ষা, ওষুধ খাওয়ানো, টিকাকরণ, মেডিক্যাল ইতিহাস নথিভুক্ত করা, হাসপাতালে প্রসব থেকে বাচ্চার টিকাকরণ, ম্যালেরিয়ার স্লাইড পরীক্ষা, ডটের ওষুধ খাওয়ানোএমন হাজারো কাজ করতে হয় ধাত্রীসহায়িকাদের। এত কাজ করতে গিয়ে ক্লান্তিতে বা তাড়াহুড়োয় হিমোগ্লোবিন পরীক্ষায় ভুল হয়ে যেতেই পারে। অথবা অন্তঃসত্ত্বার স্বাস্থ্য-পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড-এ নথিভুক্ত করার সময় কোনও ভুল হতেই পারে।
ঘটনা যাই হোক, স্বাস্থ্য কর্তার নির্দেশে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ধাত্রীসহায়িকারা কতটা ঠিক পদ্ধতিতে অন্তঃসত্ত্বার রক্ত পরীক্ষা করতে পারছেন বা তথ্য নথিভুক্ত করার সময় গোলমাল করছেন কি না, তা নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক ও জনস্বাস্থ্য সেবিকাদের। তাঁদের কাজের উপর আবার নজরদারি চালাবেন স্বাস্থ্য দফতরের কিছু অফিসার। তবে দুই স্তরের এই নজরদারি ব্যবস্থা কতটা সম্ভব হবে, তাই নিয়ে অবশ্য শুরুতেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
স্বাস্থ্য ভবনের মতে, গোটা দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার মাত্রা বেশি। এঁদের মধ্যে আবার হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৭-এর নীচে থাকা অন্তঃসত্ত্বাদের প্রবল রক্তাল্পতা আছে ধরা হয়। পরীক্ষা করে এঁদের চিহ্নিত করতে না-পারলে তাঁদের যথেষ্ট পরিমাণ আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ানো যায় না এবং প্রয়োজন মতো রক্তও দেওয়া যায় না। এর পরিণতিতে প্রসবের সময় বা প্রসবের পরে তাঁরা মৃত্যুমুখে পড়তে পারেন। স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে নবজাতকেরও। তাই এ ক্ষেত্রে পরীক্ষাটা সঠিক হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
তদন্তের অঙ্গ হিসাবে দুই স্তরের নজরদারি চালু হলে তা সম্ভব হবে কি না, অথবা ধাত্রীসহায়িকাদের কাজের চাপ কমাতে কর্তারা কিছু পদক্ষেপ করবেন কি না, তার উত্তর জানা যাবে ভবিষ্যতে। |