কয়েক মাস বয়স থেকেই বাচ্চাটার জ্বর। সর্দি-কাশিও লেগেই থাকত। সঙ্গে আবার শ্বাসকষ্টও। বাড়ির বড়দের পরামর্শে বুকে-পিঠে তেল মালিশ করে রোদে শুইয়ে রাখার মেয়াদ আরও কিছু দিন বাড়ানো হল। যাতে ঠান্ডা না লাগে, তাই বাইরে বেরোলে কান-মাথা আষ্টেপৃষ্ঠে ঢেকে রাখাও হতো। তবু সমস্যাটা কমলো না। কয়েক বছর এ ভাবে চলার পরে সন্তানকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখালেন বাবা-মা। আর পরীক্ষানিরীক্ষা করে ধরা পড়ল শিশুটির হার্টে জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। প্রয়োজন দ্রুত অস্ত্রোপচার।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও করুণ। জন্মের পরেই নীল হয়ে গিয়েছিল শিশুটির শরীর। কান্নাও শুরু হয়েছিল দেরিতে। এর পর নানা অসুখ লেগেই থাকত। কিন্তু এ নিয়ে কেউই আলাদা করে কখনও মাথা ঘামাননি। বয়স তখনও দু’বছর পেরোয়নি। হঠাৎই এক দিন দুপুরে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট শুরু হল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল ঠিকই, কিন্তু বাঁচানো গেল না। ডাক্তাররা জানালেন, জন্ম থেকেই হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা ছিল। সময়ে ধরা পড়লে হয়তো বাঁচানো যেত শিশুটিকে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। যদিও এ রাজ্যে যথেষ্ট চিকিৎসা পরিকাঠামো নেই। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজির পৃথক বিভাগ থাকলেও সরকারি বলতে একমাত্র এসএসকেএমেই রয়েছে। তবে না থাকলেও একেবারে অমিল নয়। তবু সচেতনতার অভাবে শিশুদের হৃদরোগ ধরা পড়ছে অনেক দেরিতে। চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, সময়ে ধরা পড়লে বহু ক্ষেত্রেই ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের সাহায্যে সুস্থ জীবনে ফেরানো সম্ভব। কিন্তু অভিভাবকেরা সচেতন না হওয়ায় বহু ক্ষেত্রেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। |
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর দেশে যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ১০ শতাংশই হৃদরোগে। এমনকী বহু প্রাপ্তবয়স্ক রোগীও আসেন, যাঁদের সমস্যাটা জন্মগত। সঠিক সময়ে রোগ নিণর্য় হয়নি, তাই পরবর্তী সময়ে চিকিৎসায় ফল কম হয়।
পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জন শ্রীরূপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যে দেশে ডায়েরিয়ায় অসংখ্য শিশুর মৃত্যু হয়, সেখানে শিশুদের হার্টের সমস্যা দ্রুত ধরা পড়বে, এটা আশা করব কী করে? প্রত্যন্ত গ্রামের ক’টি শিশুর জন্মের পর শারীরিক পরীক্ষা হয়? কিছুই হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও শিশুকে যখন আমাদের কাছে আনা হয়, তত ক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।”
শিশুদের হার্টের সমস্যা কেন হয়? চিকিৎসকদের মতে, বহু ক্ষেত্রেই তার নির্দিষ্ট কোনও কারণ জানা যায় না। তবে গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে মায়ের কোনও ধরনের সংক্রমণ হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডাউন সিনড্রোমের বাচ্চাদেরও জন্মগত হার্টের সমস্যা বেশি। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে ঝুঁকি তৈরি হয়।
কার্ডিওলজিস্ট অরুণাংশু গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত হার্টের সমস্যা নিজে থেকেই ঠিক হয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন। ওপেন হার্ট সার্জারি করে বা ধমনীর মধ্যে দিয়ে ক্যাথিটার ঢুকিয়ে হার্টের গঠনগত ত্রুটি দূর করা হয়। কিন্তু কার ক্ষেত্রে কোনটা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেন একমাত্র পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টই। তাই সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।”
এসএসকেএমের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট অচ্যুত সরকার বলেন, “সচেতনতা এখনও অনেক কম। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে তবু গোড়াতেই অনেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যান। কিন্তু মধ্য বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসুখ ধরা পড়ছে দেরিতে। অথচ শুধু সন্তান জন্মের পরে নয়, বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে জন্মের আগেই গর্ভস্থ শিশুর হার্টের হাল-হকিকত এখন বোঝা সম্ভব।”
সাধারণ ভাবে কী কী সমস্যা হয় শিশুদের হার্টে? কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসু বলেন, “দু’টি অলিন্দের মাঝের পর্দায় বা দু’টি নিলয়ের মাঝের পর্দায় অনেকের ফুটো থাকে। জন্মগত ভাবে ‘পালমোনারি আর্টারি’ এবং ‘সাবক্লেভিয়ান আর্টারি’র মধ্যে যোগ থাকায় নানা জটিলতা দেখা দেয়। বহু শিশু জন্মের পরেই নীল হয়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে বহু সময়ে অপরিশোধিত রক্ত শরীরে মেশে। ফল মারাত্মক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাই অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি।”
সচেতনতার অভাবই যে একমাত্র সমস্যা, তা নয়। এসএসকেএমে মাত্র ১৮টি শয্যা। রোগীর বিপুল চাপের তুলনায় চিকিৎসক, নার্স কম। অচ্যুতবাবু বলেন, “শিশু হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের আউটডোরেই এক বছরে ৩০% রোগী বেড়েছে। হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগে একটি ক্যাথ ল্যাব (হৃদরোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়) চালু হতে চলেছে। আশা, তাতে বহু গরিব রোগী চিকিৎসার সুযোগ পাবেন।”
বেসরকারি হাসপাতালেও ছবিটা খুব উজ্জ্বল নয়। শিশুদের জন্য বিশেষ ইকোকার্ডিওগ্রাফির যন্ত্রও নেই বেশিরভাগ জায়গায়। নেই প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানও। বহু জায়গায় সাধারণ কার্ডিওলজিস্টরাই চিকিৎসা করেন। বিশেষজ্ঞরা মানছেন, পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজির যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত, বহু ক্ষেত্রেই ততটা দেওয়া হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। হাসপাতালগুলি এর সঙ্গে তাল না রাখায় ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরই তার খেসারত দিতে হচ্ছে। |