বঙ্গ চিকিৎসা সম্মান
রেফার না -করলে বেশি নম্বর, কিন্তু হিসেব রাখছে কে
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহিত করতে ‘বঙ্গ চিকিৎসা সম্মান’ দেওয়া হবে, ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহেই এই পুরস্কারের সূচনা হয়েছে। আগে কেবল ভাল হাসপাতালগুলিকে পুরস্কৃত করা হত। কিন্তু উদ্যমী কর্মীদের স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী তাঁর সরকার, তা মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন। পুরস্কার অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হয়েছে ১৯ অগস্ট।
কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার আগ্রহকে ছাপিয়ে গিয়েছে পুরস্কারের শর্ত নিয়ে বিতর্ক। সরকারি ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী মহলে জোর তর্ক চলছে, কম রোগী ‘রেফার’ করলেই যদি বেশি নম্বর মেলে, তা হলে জরুরি রোগীকেও না -পাঠানোই ভাল? পুরস্কার পাওয়ার ঝোঁকে কি রোগীর ভিড় ফেলে স্বাস্থ্যশিক্ষার সেমিনার করবেন ডাক্তাররা?
বিতর্ক অবশ্য পুরস্কারের পিছু নিয়েছে একেবারে গোড়া থেকে। পুরস্কারের অর্থমূল্য এবং অন্যান্য কোন খাত থেকে ব্যয় হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ঘোষণা -পর্বেই। বার যোগ্যতা বিচারের মাপকাঠি (বক্স দেখুন ) প্রকাশিত হতে নতুন বিতর্কের সামনে পড়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
কী কী বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছে?
জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারদের (জিডিএমও ) বাছাইয়ের শর্ত, তিনি তাঁর ব্লকে কতগুলি সংক্রামক রোগ ব্যাপক হারে ছড়ানো ঠেকানোর কাজে সাহায্য করেছেন? এ জন্য আলাদা নম্বর রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যাঁর ব্লকে রোগের প্রাদুর্ভাব হয়নি, তিনি কেন নম্বর পাবেন না?

পুরস্কার পরিচিতি
কী পুরস্কার?
কারা পাবেন? জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার
বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল অফিসার
ব্লক মেডিক্যাল হেলথ অফিসার
হাসপাতাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট
শল্য চিকিৎসক
মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট
ফার্মাসিস্ট অন্য প্যারা -মেডিক্যাল কর্মী
ধাত্রী সহায়িকা (এএনএম)
স্বাস্থ্য সহায়ক
নার্স এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা।
কতগুলি পুরস্কার?
কী দেওয়া হবে? ২৫ হাজার টাকা, মানপত্র, উত্তরীয়
কোন খাত থেকে বরাদ্দ?

দ্বিতীয়ত, যত কম রোগী ‘রেফার’ করবেন, তত বেশি নম্বর পাবেন জিডিএমও। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, ৯৫ % হাসপাতালে ‘রেফারাল রেজিস্টার’ রাখাই হয় না। তা হলে হিসাব হবে কী ভাবে?
নম্বর রয়েছে ব্লকে স্বাস্থ্য -শিক্ষামূলক আলোচনাসভার সংখ্যার উপরেও। মেডিক্যাল অফিসারদের একটা বড় অংশ দাবি করেছেন, কর্মীর অভাবে রোগীর চাপ সামলে বেশি সেমিনার আয়োজন করা কার্যত অসম্ভব, উচিতও নয়।
ব্যাপারে চিকিৎসা সম্মান প্রদানের অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য দফতরের মেডিক্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের যুগ্মসচিব আশিস মল্লিক বলেন, “কারও ব্লকে রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তাঁর পরিশ্রম বেশি হয়, তাই তিনি বেশি নম্বর পাবেন। আর হাসপাতালে রেফারাল রেজিস্ট্রার না থাকলে নম্বর কাটা যেতে পারে ভেবে ডাক্তাররাই কর্তৃপক্ষকে রেজিস্ট্রার রাখতে চাপ দেবেন। সে তো ভালই হবে।”
এমন বিতর্কের মধ্যে থেকে যে মূল প্রশ্নটা উঠে এসেছে তা হল, সরকারি ডাক্তারের কাজের মূল্যায়ন কী ভাবে হওয়া উচিত? কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যঅধিকর্তা জগদীশ প্রসাদ বলেন, “একটি নিরপেক্ষ কোর কমিটি গঠন করতে হবে। তারাই সকলের সঙ্গে কথা বলে কোনও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে।”
‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস’ (এইমস )-এর মেডিক্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডি কে শর্মার মতে, দু’টি মূল মাপকাঠি হতে পারে। এক, চিকিৎসায় সাফল্য ( ‘ক্লিনিক্যাল অ্যাচিভমেন্ট’) এবং দুই, ব্যবহার। প্রথমটির মধ্যে চিকিৎসক কতটা রোগ নির্ণয় করতে পারছেন, ঠিক ওষুধ দিচ্ছেন কত ক্ষেত্রে, এবং তাঁর কাজের ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ কেমন সেটা দেখতে হবে। আর দ্বিতীয়টির জন্য রোগী, তাঁর আত্মীয়, সহকর্মী, উর্ধ্বতন অধস্তনদের সঙ্গে ডাক্তারের ব্যবহার কেমন, তা দেখতে হবে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সহকর্মী, অধস্তন কর্মী, রোগীদের থেকে তথ্য নিতে হবে। “আমরা একে বলি ৩৬০ ডিগ্রি ইভ্যালুয়েশন,” বলেন শর্মা।
রাজ্যে প্রশ্ন উঠেছে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়েই। যেমন, বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল অফিসারদের মধ্যে থেকে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করার একটি শর্ত হল, তাঁরা কত দিন ওয়ার্ডে ঠিক সময় রাউন্ড দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এটা নিয়মিত নজরদারি করেছেন কে? শর্তে আরও বলা হয়েছে, প্রেসক্রিপশনে কত শতাংশ ওষুধের ‘জেনেরিক’ নাম লিখেছেন ওই ডাক্তার, তা - বিচার হবে। যা শুনে এক শীর্ষ স্বাস্থ্য -কর্তা হেসে বলেছেন, “প্রেসক্রিপশন অডিট আবার সরকারি হাসপাতালে শুরু হয়েছে না কি?” বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল অফিসার শল্য চিকিৎসকেরা কত দিন রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করেছেন তা - অন্যতম মানদণ্ড হিসাবে গণ্য হবে। কী পদ্ধতিতে তার নজরদারি হবে? মেডিক্যাল শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কর্তৃপক্ষ সব জানেন।”
মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট শল্য চিকিৎসকদের মাপকাঠির এক জায়গায় বলা হয়েছে, রোগীর সন্তুষ্টির সূচক ( ‘পেশেন্ট স্যাটিসফ্যাকশান ইনডেক্স’)-এ প্রাপ্ত নম্বর দেখা হবে। অথচ এই ‘ইনডেক্স’ কে, কী ভাবে তৈরি করে, তাতে কী কী বিষয় দেখা হয়, তা - বলতে পারেননি অধিকাংশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গ্রুপ -ডি কর্মীদের ক্ষেত্রে কাজের সঙ্গে জড়িত ‘এক্সট্রা -কারিকুলার অ্যাকটিভিটি’-তে আলাদা নম্বর দেওয়া হবে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই ‘অ্যাকটিভিটি’ কী, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।
রাজ্যের সরকারি চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ তাই বলছেন, “সম্মান দেওয়া তো পরে। আগে সম্মানের জন্য উপযুক্ত বাছার নিক্তিটা ঠিকঠাক হওয়া দরকার ছিল।” মাপকাঠি স্বচ্ছ, স্পষ্ট না হওয়ায় স্বজনপোষণের আশঙ্কা করছেন অনেকে। যোগ্যেরা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হলে দফতরের অন্দরে ক্ষোভ বাড়তে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় তার প্রভাবও পড়তে পারে। হিতে বিপরীত হবে তা হলে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.