দশম দিনে বাঘেরা
ঙ্গল তাকে ছেড়ে গিয়েছে, এখন সে খাঁচায় বন্দি। তবুও কিছুতেই জঙ্গলের সেই দিনগুলোকে ভুলতে পারে না বাঘটা। ঘেন্নার চোখে তাকায় খাঁচার ও-পারে চেয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে। কৌতূহল ভরে আছে তাদের চোখগুলোয়, ভয়ের চিহ্নমাত্রও নেই সেখানে। নেতা-নেতা হাবভাব নিয়ে, শান্ত স্বরে তাদের এক জন বলেন, ‘আমার যা কাজ, তা-ই যদি তোমরা করবে বলে ঠিক করে থাকো, জীবজন্তুকে কী করে পোষ মানাতে হয়, সত্যিই যদি সে সব শিখতে চাও, তা হলে কখনওই ভুলে গেলে চলবে না যে প্রতিপক্ষের পেটই হল তোমাদের আসল অস্ত্র। দেখো এ বাঘটাকে; কী হিংস্র আর তেজি, যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে, জানে নিজের ক্ষমতাটা, গায়ে কত জোর— সেই গর্বেই ফুলেফেঁপে রয়েছে এখন। তবে বদলাবে ও, ছোট্ট একটা শিশুর মতোই ধীরস্থির হয়ে যাবে। মুখে রা-ও কাটবে না। খাবার আছে যার কাছে, আর যার কাছে তা নেই, দেখো তাদের মধ্যে ঘটেটা কী,  শেখো সে সব।’
হামলে পড়ল বাকি লোকগুলো, শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের একাগ্রতা প্রমাণ করার জন্য। চওড়া হাসি ফুটে ওঠে প্রভুর মুখে, বাঘটাকে ঠেস মেরে বলেন, ‘তা, আমাদের মহামান্য অতিথি আছেন কেমন?’
‘খাবারদাবারের ব্যবস্থা করুন; এখন আমার খাওয়ার সময়’, বাঘ বলল।
‘ওহে, আমার বন্দি, আমাকেই হুকুম করছ?’ অবাক হওয়ার ভান করেন প্রভু, ‘ভারী মজার বাঘ তো তুমি! তোমার তো বোঝা উচিত যে, আমিই শুধু হুকুম করি এখানে।’
‘বাঘেদের কেউ হুকুম করে না’, বাঘ বলল।
‘কিন্তু এখন তো আর বাঘ নও তুমি’, প্রভু বললেন। ‘জঙ্গলে তুমি বাঘই বটে, কিন্তু এখানে তো খাঁচায় বন্দি এক চাকর মাত্র, যে যা বলবে সবই শুনতে হবে এখন থেকে, আমার ইচ্ছে মতোই চলতে হবে তোমাকে।’
‘আমি কারও চাকর নই’, ঝাঁঝিয়ে উঠল বাঘ।
‘তোমাকে তো শুনতেই হবে আমার কথা, আমার কাছেই যে খাবার আছে’, প্রভু বললেন।
‘চাই না আপনার খাবার’, জবাব দিল বাঘ।
‘থাকো তা হলে উপোস করে’, প্রভু বললেন। ‘যেটা করতে ইচ্ছে করছে না, কোরো না।’ তার পরই, শিষ্যদের দিকে ফিরে বললেন, ‘দেখো এ বার কী করে মন বদলায় ওর, মাথা উঁচু থাকলে তো আর পেট ভরে না।’
খিদে পেল বাঘের। দুঃখে ভরে গেল তার মনটা। মনে পড়ে গেল জঙ্গলের সেই দিনগুলোর কথা, হাওয়ার বেগে ছুটতে পারত তখন, দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত শিকারের উপর।
পরের দিন, শিষ্যদের নিয়ে খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রভু।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘খিদে পেয়েছে? নিশ্চয়ই পেয়েছে, ছটফটানি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুখ ফুটে শুধু বলো সে কথা। তা হলেই খাওয়া জুটবে, যত পারো মাংস খেয়ো তখন।’
বাঘ চুপ করে রইল।
প্রভু বলে চললেন, ‘যা বলছি, তা-ই করো, বোকামি কোরো না। স্বীকার করো খিদে পেয়েছে, তা হলেই খেতে দেওয়া হবে।’
‘হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে’, স্বীকার করল বাঘ।
হেসে ফেললেন প্রভু, শিষ্যদের বললেন, ‘এ বার ফাঁদে পড়েছে বাছাধন, আর পালাবার পথ নেই।’ আদেশ করলেন তিনি, সেই মতো অনেক মাংস দেওয়া হল বাঘকে।
তৃতীয় দিনে প্রভু বাঘকে বললেন, ‘খেতে চাইলে যা বলছি করো।’
বাঘের জবাব, ‘না, করব না।’
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
‘অত ব্যস্ত হয়ো না’, প্রভু বললেন। ‘আমার বক্তব্য খুব সাধারণ। খাঁচার মধ্যে পায়চারি করছ এখন, কিন্তু যে-ই বলব ‘থামো’, অমনি থামতে হবে।’
বাঘ মনে মনে ভাবল, ‘সত্যিই খুব সামান্য অনুরোধ; শুধু শুধু গোঁয়ার্তুমি করে না খেয়ে থাকার কোনও মানেই হয় না।’
‘থামো!’ চিৎকার করে আদেশ করলেন প্রভু।
বাঘ থামল সঙ্গে সঙ্গেই।
‘এই তো উন্নতি হচ্ছে তোমার’, আদুরে সুর তাঁর গলায়।
বাঘ খুব খুশি, মনের আনন্দে খেতে লাগল, আর প্রভু তখন শিষ্যদের বোঝাচ্ছেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই এক কাগুজে বাঘ হবে এ।’
চতুর্থ দিনে বাঘ বলল প্রভুকে, ‘খিদে পেয়েছে, থামতে বলুন আমায়।’
‘এ তো আমার আদেশগুলোর প্রেমে পড়ে গিয়েছে দেখছি’, শিষ্যদের বললেন প্রভু। বাঘের দিকে ফিরে তার পর বললেন, ‘আজকে তোমায় বেড়ালছানার ডাক ডাকতে হবে, নইলে খাওয়া বন্ধ।’
বাঘ তার রাগ হজম করল। তার পর মনে মনেই বলল, ‘বেড়ালছানার ডাক ডাকা, সে তো মজারই ব্যাপার।’ তা-ই করল সে।
ভুরু কুঁচকে গেল প্রভুর, বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘ভয়ংকর। এ তো বাঘের ডাক, মিউ মিউ তো নয়।’
বাঘ আবার চেষ্টা করল, প্রভুর মুখে হাসি ফুটল না তবুও।
‘একদম চুপ’, চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘ভয়ংকর তোমার এ ম্যাও ডাক। এক দিন সময় দিলাম, কালকে পরীক্ষা নেব। পারলে খাওয়া জুটবে, না হলে নয়।’
ধীর পায়ে খাঁচা ছেড়ে চলে গেলেন প্রভু। শিষ্যদেরও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। চাপা স্বরে কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল তারা, কথা বলছিল ফিসফিস করে।
বাঘটা চিৎকার করে উঠল। প্রার্থনা জানাল জঙ্গলের কাছে। কিন্তু সে সব যে বহু দূরে এখন!
পঞ্চম দিনে প্রভু বাঘটাকে বললেন, ‘বেড়ালছানার ডাক ডাকতে পারলেই বড় একটা মাংসের টুকরো পাবে তুমি।’
এ বারে পারল বাঘ। প্রভু তালি দিয়ে উঠলেন। ‘অসাধারণ!’ উল্লাস তাঁর গলায়। ‘এ তো এক রাগী বেড়ালের ডাক।’ বড় মাংসের টুকরো ছুড়লেন বাঘটার দিকে।
ষষ্ঠ দিনে, প্রভু খাঁচার কাছে আসতেই বাঘ ডাকল ‘মিউ’, প্রভুর ভুরু যদিও কুঁচকেই রইল। ‘আমি যে বেড়ালছানার ডাকই ডাকলাম’, বাঘ বলল। প্রভুর আদেশ, ‘গাধার ডাক ডাকো এ বার’।
অপমানে কুঁকড়ে গেল বাঘ, বলল, ‘আমি বাঘ। জঙ্গলে সব পশুরা ভয় পায় আমায়। আমি ডাকব গাধার ডাক? তার চেয়ে তো মরে যাওয়াও ভাল।’
প্রভু কোনও উত্তর দিলেন না, খাঁচা ছেড়ে চলে গেলেন শুধু।
সপ্তম দিনে আবার খাঁচার কাছে এসে দাঁড়ালেন প্রভু, মুখে মুচকি হাসি তাঁর।
‘খাবারদাবার চাই, না কি?’
‘চাই’, বাঘ উত্তর দিল।
‘তা হলে ওই একই শর্ত’, বললেন তিনি। ‘ডাকো গাধার ডাক।’
জঙ্গলের দিনগুলোর কথা মনে করার চেষ্টা করল বাঘ, পারল না। চোখ বুজে শুধু গলা দিয়ে বার করল ‘চিঁ-চিঁ!’
‘খুব একটা ভাল হল না, তবু দয়া করে একটা টুকরো দিচ্ছি’, প্রভু বললেন।
অষ্টম দিনে, প্রভু বাঘকে বললেন, ‘এ বার একটা বক্তৃতার শুরুর অংশ বলছি, শেষ হলেই ভাল লেগেছে ভাব করে হাততালি দিতে হবে তোমায়।’
‘নিশ্চয়ই দেব’, বাঘ বলল।
প্রভু শুরু করলেন, ‘বন্ধুগণ... এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কর্তব্য কী, তা নিয়ে এর আগে আমরা বহু আলোচনা করেছি। মনে যদি বিশ্বাস থাকে, জয় আসবেই। শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রও সে সংকল্প থেকে টলাতে পারবে না আমাদের।’
‘কিছুই বুঝলাম না’, বাঘ বলল।
‘আমি যা বলব, তা-ই তোমার ভাল লাগতে হবে, আর তাতেই মহা উৎসাহে হাততালি দিতে হবে তোমায়।’
‘মাপ করবেন’, বাঘ বলল। ‘বড় অবুঝ আমি। আপনি চাইলেই হাততালি দেব, অসাধারণ বলেছেন’, বলেই হাততালি দিল বাঘ।
‘এ সব ভণ্ডামি মোটে সহ্য হয় না আমার’, প্রভু বললেন। ‘আজ খাওয়া জুটবে না, এই শাস্তি তোর।’
নবম দিনে প্রভু এলেন এক ধামা বিচুলি নিয়ে। ছুড়ে দিলেন বাঘটার দিকে।
‘খা’, বললেন তিনি।
‘এ কী!’ বাঘ বলল, ‘আমি তো মাংস খাই।’
‘এখন থেকে এই-ই খেতে হবে তোকে, আর কিছু জুটবে না’, জবাব দিলেন প্রভু।
তার পর খিদে পেতেই, সেই বিচুলিই খেতে চেষ্টা করল বাঘটা। মুখে দিতেই শিউরে উঠল প্রথমে, ঘেন্নায় ছিটকে পালাল। পরে অবশ্য ফিরেও এল আবার, ধীরে ধীরে তার পর অভ্যাস হয়ে গেল সেই বিচুলির স্বাদই।
দশম দিনে, প্রভু, শিষ্যরা, বাঘ, খাঁচা— সবই গেল উধাও হয়ে। বাঘটা হল নাগরিক, আর তার খাঁচাটা হল দেশ।

অনুবাদ নীলাব্জ দাস



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.