সবাই তাকিয়ে আছে ওপরে। তাই আমিও। আকাশ নয়, মাথার ওপর বিশাল ভল্টেড সিলিং। সেখানে পর পর ছবি আঁকা আছে, প্যানেল করে, ন’খানা। প্রথমটার নাম জেনেসিস। সব কিছুর শুরু, অন্ধকার থেকে আলোর সৃষ্টি। সূর্য। চন্দ্র। জল। আদম। ইভ। মহাপাপের উপাখ্যান। চার পাশের ঠাসা ভিড়টা নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে বেশি জানে। কেউ কেউ আইগ্লাস বা ছোট দূরবিন দিয়ে দেখছে। তাদের মুগ্ধতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। আবার চোখ তুললাম। চার নম্বর প্যানেলে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে থাকার দৃশ্য, স্রেফ কয়েক লক্ষ ভোল্ট স্পর্শের তেজে আদমের সৃষ্টি। এটা আমার চেনা ছবি। এর পরে আবার পাপ পুণ্যের চিত্রায়ণ। পাপই বেশি। পুণ্য বলে কিছু হয় না বোধ হয়। পাপের প্রয়োজনেই পুণ্যের জন্ম। ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্ট-এর মহাকাব্যিক কল্পদৃশ্যের অংশবিশেষ নিয়ে এই সব মহাচিত্র আঁকা হয়েছিল পাঁচশো বছরেরও আগে। খ্রিস্টধর্মের পীঠস্থান ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে প্রায় একাই কাজটা করেছিলেন মাইকেলএঞ্জেলো।
ছোট দরজা দিয়ে আরও লোক আসছে, চাপ বাড়ছে আমাদের ভিড়টার ওপর। ফলে আমরা সরে যাচ্ছি উলটো দিকে, বেরনোর দরজার দিকে মুখ করে। সিলিং-এর শেষে, দেওয়ালে আরও ছবি আছে। রয়েছে ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’। মৃত্যু ও পাপের ভয়ানক সব ইঙ্গিত। মানুষের মনের অন্ধকার দিকটা নিয়ে আর্টিস্টিক কারবার। এটাও মাইকেলএঞ্জেলো। কাছে পৌঁছতে পারলাম না। মানুষের চাপে ছিটকে বেরিয়ে এলাম বাইরে। একটা ঘোর। অন্যমনস্কতা। বুক থেকে কোমর অবধি একটা খালি হয়ে যাওয়া ভাব। অদ্ভুত একটা স্পর্শ। জ্যাকেটের ওপর দিয়ে নিজেকে ছুঁতেই বুঝতে পারলাম কী ঘটেছে। হাপিশ হয়ে গেছে মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট। হাজার হাজার নগ্ন এঞ্জেল ও ডিমনদের মধ্যে নিজেকে উলঙ্গ মনে হল মুহূর্তের জন্য।
বিদেশ বিভুঁইয়ে একা অবস্থায় পকেটমারা গেলে মহা বিপদ। কিন্তু তেমন বিরক্ত লাগছিল না। শুধু বার বার জ্যাকেটের ভেতরের পকেটটা হাতড়াচ্ছিলাম অকারণে। পুরনো রোমের গলিতে আমার বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি। থাকা-খাওয়ার চিন্তা নেই। শহরে ঘুরঘুর করা, দরকারে মেট্রোতে চড়ার মতো টাকা ছিল, এখন সেটাও নেই। পাসপোর্ট হারালে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হবে একটা কিছু। আসল ঝামেলা অন্য, ঠিকানা মনে নেই। রাস্তার নামটাও মনে পড়ছে না। টেনশন কাটলে মনে পড়বে নিশ্চয়ই। তখন না হয় জিজ্ঞেস করে করে যাওয়া যাবে। অনেক সময় আছে হাতে, ভ্যাটিকান মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখা যেতে পারে। রাফায়েলের ছবি দেখা বাকি। পিয়েতা দেখা বাকি। বাইরে সেন্ট পিটার্সের চত্বরে যাওয়া বাকি।
মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার মুখে বাইরে এলাম, সন্ধে হয়ে এসেছে, বৃষ্টি পড়ছে, লোকজনও কম। ঠিক করলাম আন্দাজে চিনে চিনে বাড়ি অবধি পৌঁছে যাব। চার পাশে প্রচুর হাসিখুশি ট্যুরিস্ট, ছবি তুলছে। ঝলমলে দোকানপাট। আর ভাল লাগছে না। টিবার নদীর ওপরের ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলাম রোমে। ভ্যাটিকান তো একটা আলাদা দেশ। |
হাঁটতে হাঁটতে, এ রাস্তা ও রাস্তা ছেড়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম অন্যমনস্ক ভাবে। এক-আধখানা ছোট খাবার দোকান দেখা গেল, আর সব জায়গায় শাটার নামানো। এখানে বোধ হয় ট্যুরিস্টরা বেশি আসে না। লোকজনও কম। মাঝেমধ্যে মোটরবাইক যাচ্ছে আওয়াজ করে। পুরনো সব বাড়ি, পলেস্তারা খসা দেওয়াল। বারান্দায় ফুলের টব, অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে। অনেক জানলার ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড খোলা, আলো জ্বলছে ভেতরে। দূর থেকে সেন্ট পিটার্সের ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। ডান দিকে আর একটা গলি। একটু অন্ধকার। ভিজে পাথরের রাস্তা। দূরে ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। ওটা টানছিল আমাকে। ঢুকে পড়লাম। কাছাকাছি পৌঁছতেই আলোটা কয়েক বার দপ দপ করে নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চার পাশটা একেবারে কালো হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালাম। তার পর অকারণে পিছনে তাকালাম। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ এক জন। ও দিকে ফেরার কোনও মানে হয় না। হাঁটতে শুরু করলাম সামনের দিকে। নিশ্চয়ই বড় রাস্তা পড়বে।
হাঁটতে হাঁটতে এক বার মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, লোকটা চলতে শুরু করেছে। আমার দিকেই আসছে। আমি হাঁটার গতি বাড়ালাম। ভেবে একটু হাসি পেল যে ছিনতাইবাজ হলে খুবই হতাশ হতে হবে ওকে। অবশ্য কিছু না পেলে অন্য বিপদও রয়েছে। সরু গলিটা হালকা চড়াইতে উঠছে, ফলে স্বাভাবিক হাঁটার গতি কমে গেছে আমার। হঠাৎ দৌড়তে শুরু করার কোনও কারণ থাকলেও সেটা করা যায় না। একটা দোকান বা বাড়ির দরজা খোলা থাকলেই ঢুকে পড়ব। তার পর যা হবার হবে। বাড়ির দরজা সবই বন্ধ। দেখে মনে হয় পুরনো ফ্ল্যাটবাড়ি, আলাদা আলাদা পরিবার থাকে। দরজার পাশে তাদের পদবি আর বেল-এর বোতামও থাকে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে ডাকাডাকি করাটাও কাজের নয়। জুতোর আওয়াজটা এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে দৌড়তে শুরু করলাম।
লোকটাও নিশ্চয়ই দৌড়চ্ছে। তার জুতোর শব্দ দ্রুত হয়েছে। পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস হল না। ডান দিকে আর একটা অন্ধকার কিন্তু ফাঁকা গলিতে ঢুকে পড়লাম। লোকটার গলা শুনতে পাচ্ছি, আমাকেই বলছে নিশ্চয়ই, ‘ফারমাতে, ফারমাতে—’। মনে হল গলির শেষ মুখে আলো জ্বলছে। ও দিকেই যেতে হবে। কিন্তু পা স্লিপ করল। ধড়াম করে পড়লাম রাস্তায়। থুতনিটা ঠুকে গেল ফুটপাতের পাশের পাথরে। ঘাড়ের কাছে জ্যাকেটের কলারে টান পড়ল। পিঠের ওপরে ভারী শরীরের চাপ। লোকটা পেড়ে ফেলেছে আমাকে। সেও হাঁপাচ্ছিল। নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি কোনও কথা বলছিলাম না। সেও নয়। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম, হাঁটুতে লেগেছে, পালাতে পারব না। লোকটা ধরে রইল আমাকে। তার পর আমার পকেটে হাত ছোঁয়াল। একটা লাইটার পেয়ে রেখে দিল নিজের কাছে। তার পর তাকাল আমার দিকে। আমি দেখলাম ওকে। ইতালিয়ান মনে হল না। আফ্রিকানও নয়। নাক, মুখ কাটা কাটা নয়, চোখের দৃষ্টিতে ক্লান্তি। কেন জানি না, বাংলায় বললাম, ‘মারবেন না।’ লোকটা তাকিয়ে রইল, তার পর আমার কাঁধে হাত রেখে একটু চাপ দিল, কোমরে ঠেলা মারল। তার মানে— চলতে থাকো। আমি এগোলাম খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
রোমের চোর, ছিনতাইবাজ, ইললিগাল ইমিগ্রান্টদের কথা আগেই শুনেছিলাম। পূর্ব ইউরোপের গরিব দেশ থেকে অনেকে ঢুকে পড়ে ইতালিতে। বড় শহরে থাকে গোপন আস্তানায়। কেউ কেউ ফেরিওয়ালা বনে যায়। এশিয়ানরাও আছে। চিনারা ব্যবসা ফাঁদার চেষ্টা করে। বাংলাদেশিরা কাজ খোঁজে খাবারের দোকানে। ভারতীয়দের ব্যাপারটা জানি না। যার খপ্পরে পড়েছি সে কোথাকার লোক বোঝার উপায় নেই। দুনিয়ার সব পাপীদের চেহারাটা বিশ্বায়নের পর বোধ হয় এক হয়ে গেছে। স্রেফ চেহারা দেখে ভাল মন্দ বোঝার উপায় নেই। দাঁড়ালাম এক বার, বললাম, ‘ট্রেভি ফাউন্টেনটা কোন দিকে?’ ইংরিজিতে। লোকটা আবার ঠেলা মারল কোমরে। ঠিক পিছনে নয়, মানুষটা হাঁটছে আমার পাশে। হাতটা আমার কাঁধের ওপরেই রয়েছে। আমি পালাবার চেষ্টা করলেই ধরবে। কিছুটা দূরে লোকজনের গলার আওয়াজ পেলাম, আলো জ্বলছে, দোকান রয়েছে বোধ হয়। কাঁধে চাপ পড়ল। আমরা নতুন একটা গলিতে ঢুকলাম। আস্তে আস্তে চলছি। কিন্তু থামছি না। সবুজ একটা প্লাস আর লেখা ফার্মাসিয়া, নিয়ন আলোর সাইন জ্বলছে, দোকান বন্ধ, এর সামনে থামলাম। এ বারে সে হাতের আঙুলগুলো এক জায়গায় সরু করে নিজের মুখের কাছে বার দুয়েক নিল, তার পর নামিয়ে রাখল। ওর কি খিদে পেয়েছে? খেতে চায়? অন্য দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তির মতো করে বলল, ‘নো প্রিকুপারতি।’
বুঝতে পারছিলাম গলি ছেড়ে আমরা ছোট রাস্তায় পড়েছি। লোকজন, আলো বেশি। টার্কিশ কেবাবের দোকানে পেল্লায় মাংসর খণ্ড ঘুরিয়ে ঝলসানো হচ্ছে। গায়ে গা লাগিয়ে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা হাহা হিহি করতে করতে মাতালের মতো হাঁটছে। চোখে পড়ছে বাড়ির জানলার কাচের ও পাশে চোখ বুজে মোটা বেড়াল বসে আছে গম্ভীর মুখে। কানে আসছে নানা রকম আওয়াজ, নানা ভাষায় হাসাহাসি, কথাবার্তা। শুরু হয়ে গেছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, ভিজেই চলেছি। খেয়াল করলাম নিজের ট্রাউজারে একটু কাদা আর রক্তের ছোপ, চিনচিনে ব্যথাটা টের পেলাম নতুন করে।
দুম করে পৌঁছে গেলাম ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনে। রাজকীয় স্থাপত্য আলোয় ঝলমল করছে। সামনে পাথর বাঁধানো শহুরে পুকুর। ফোয়ারা। মার্বেলের তৈরি সৌম্যকান্তি নগ্ন পুরুষ বাগ মানাবার চেষ্টা করছে শুভ্র পক্ষীরাজকে। জলের নীচে রাশি রাশি পয়সা পড়ে আছে, লোকে ফেলে দিয়ে যায়। বিশ্বাস, তা হলে আবার আসা হবে এই অপরূপ শহরে।
খেয়াল ছিল না সঙ্গের লোকটার কথা। কাঁধে চাপ পড়ল, সে এখন আমাকে আর ঠেলছে না, শুধু নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়েছে আমার দিকে। করমর্দনের জন্য নয়। কারণ মুঠোটা বন্ধ। আমি নিশ্চিন্তে খুললাম ওর ময়লা আঙুলগুলো। দেখি এক ইউরোর একটা কয়েন। চকচক করছে। |