রসনার রাজ্যভাগে অন্ধ্র-তেলেঙ্গানা বিরিয়ানি যুদ্ধ
বিরিয়ানি তুমি কার? নামে তো হায়দরাবাদি! কিন্তু হায়দরাবাদ তো এ বার শুধু অন্ধ্রের নয়! তেলেঙ্গানা আলাদা রাজ্য হলে হায়দরাবাদ তো তেলেঙ্গানারও হবে! তখন বিরিয়ানির ‘কাস্টডি’ কার হবে, এই নিয়ে বেধেছে তর্ক!
হায়দরাবাদের বিখ্যাত প্যারাডাইস রেস্তোরাঁর এসি হলে টেবিলের উল্টো দিকে বসেছিলেন প্রসাদ রেড্ডি। প্লেটের ওপর মটন দম বিরিয়ানি ঢেলে দিচ্ছেন ওয়েটার। আপনি কি হায়দরাবাদেরই বাসিন্দা? প্রসাদ জবাব দিলেন, “না কাজে এসেছি, বাড়ি আসলে কাড়াপা।” সে তো রায়লসীমা! তা হলে তো এই বিরিয়ানি আর আপনাদের রইল না! প্রসাদ এ বার হেসে ফেললেন। বললেন, “এই বিরিয়ানি না তেলেঙ্গানার, না রায়লসীমার। এটা হায়দরাবাদি।”
প্রসাদ না হয় হাসছেন! কিন্তু অনেকের কাছেই বিষয়টা হাসির নয়! তেলেঙ্গানা-পন্থীরা অনেকে এমনও দাবি করছেন যে, হায়দরাবাদি বিরিয়ানিকে এত দিন অন্ধ্রের দাসত্ব করতে হচ্ছিল! এত দিনে সে নিজের প্রকৃত পরিচয় ফিরে পেতে চলেছে!
রাজধানীর অন্ধ্রভবনে বিরিয়ানিকে এ যাবৎ অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গেই ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে! শুধু বিরিয়ানি নয়, তেলেঙ্গানা-সহ সমস্ত রান্নাই পরিচিত অন্ধ্রপ্রদেশের পদ হিসেবেই। ‘তেলেঙ্গানা অ্যাকশন কমিটি’র সহ-আহ্বায়ক রামকৃষ্ণ হেগড়ে অন্ধ্র ক্যান্টিনে দাঁড়িয়েই বললেন, “বিরিয়ানি রায়লসীমা বা অন্ধ্রপ্রদেশের রান্না নয়। অন্ধ্রে বিরিয়ানি বানানোর কোনও ঐতিহ্যই নেই। অন্ধ্রে যেটা বানানো হয় সেটা হল চিকেন বা মটনের পোলাও। আলাদা করে মুর্গি বা পাঁঠা মশলা দিয়ে সেদ্ধ করে সেটা ভাতের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে হায়দরাবাদের দম বিরিয়ানির কোনও সম্পর্ক নেই।”
অন্ধ্র কিন্তু দখল ছাড়তে নারাজ। অন্ধ্র ভবনের তথ্য আধিকারিক কিরণ কুমারের বক্তব্য, “হায়দরাবাদের বিরিয়ানি আবার তেলেঙ্গানার কোথায়! এটা তো নিজামদের ঐতিহ্যে গড়ে উঠেছে। এটা না অন্ধ্রের, না তেলেঙ্গানার!” ক্যান্টিনে প্রতিদিন হাজার মানুষের খাওয়াদাওয়ার তদারকি করেন বেণু জেকব। রায়লসীমার লোক। রাজ্যভাগ হয়ে অদূর ভবিষ্যতে তেলেঙ্গানা ভবন তৈরি হলে কি বিরিয়ানির দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়বে? জেকব বলছেন, “অন্ধ্র এবং তেলেঙ্গানা এই দু’জায়গার খাবারের পদ ৯৮% এক। বিরিয়ানিরও বেশি তফাৎ নেই। শুধু আমরা যেটাকে বলি রসম, সেটাই তেলেঙ্গানায় চারু বা পাচ্চি পুলসি।”
ভিন্ন যুক্তির পাল্লাও কম ভারী নয়। প্যারাডাইস রেস্তোরাঁর ম্যানেজার মকসুদ আহমেদ বললেন, “রাজ্য ভাগ হোক বা না হোক, বিরিয়ানি তেলেঙ্গানারই। হায়দরাবাদের নিজামরা তেলেঙ্গানা শাসন করেছেন। রায়লসীমা আর হায়দরাবাদের বিরিয়ানির ফারাক আছে।” কী ফারাক? প্যারাডাইসের মাস্টার শেফ আনোয়ার পাশা বলতে লাগলেন, “বাপ-ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, আওরঙ্গজেবই নাকি বিরিয়ানির এই ঘরানা নিয়ে এসেছিলেন হায়দরাবাদে। নিজামরা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছেন। তার সঙ্গে এই ঘরানায় পারস্যের ছোঁয়াও আছে।”
কী রকম? অন্ধ্র ভবনে সে গল্প শোনালেন হেগড়ে। নিজামদের সঙ্গে বহু ইরানি এসেছিলেন হায়দরাবাদে। ইরানের ছোট সামোসা-র চল সেই থেকেই হায়দরাবাদে আসে। আবার সপ্তম নিজামের এক স্ত্রীর নাম ছিল নিলোফার, যিনি এসেছিলেন তুরস্ক থেকে। বাপের বাড়ি থেকে পাচক এনেছিলেন। তাই তেলেঙ্গানার আমিষ রান্নায় বুখারা এলাকার ঐতিহ্যও মিলেমিশে গিয়েছে।
রন্ধন প্রণালীর তফাৎ নিয়েও হেগড়ের কথার সঙ্গে একেবারে মিলে যায় আনোয়ার পাশার বক্তব্য। “হায়দরাবাদের আসল বিরিয়ানি হল কাচ্চি গোস্তের বিরিয়ানি। কাঁচা মাংস মশলা ও দই মাখিয়ে অনেক ক্ষণ রেখে দেওয়া হয়। তার পর সেই মাংস আর চাল একই সঙ্গে দমে বসানো হয়। কিন্তু অন্ধ্রের বিরিয়ানিতে আগে মাংস রান্না করে নেওয়া হয়। সেটা হল পাক্কি গোস্তের বিরিয়ানি। ওই বিরিয়ানি ভারী এবং মাখা। কিন্তু হায়দরাবাদের বিরিয়ানি হাল্কা। গন্ধও আলাদা।”
প্যারাডাইসের আর এক শেফ সরদার খান (সেরা হালিম রান্নার পুরস্কার পেয়েছেন) জানালেন, “হায়দরাবাদি ঘরানার বিরিয়ানি শুধু নয়। এখানে যে ইরানি হালিম পাওয়া যায়, তা অন্ধ্রের অন্য কোথাও কপাল ঠুকলেও মিলবে না। পত্থর কি গোস্ত, তালাওয়া কাবাব, এ সবই হায়দরাবাদ তথা তেলেঙ্গানারই খাবার।”
গত তিন বছর ধরে সেরা হায়দরাবাদি রেস্তোঁরার খেতাব পেয়ে আসছে ‘খোলানিজ’। তাঁরা জানাচ্ছেন, তেলেঙ্গানা আর রায়লসীমার ভূপ্রকৃতি আলাদা। তেলেঙ্গানা এলাকাটি রুক্ষ, তাই এখানে জোয়ার-বাজরার রুটির চল বেশি। এখানকার বিখ্যাত পদগুলির মধ্যে রয়েছে ‘বাগারা বেগান’, ‘মিরচি কা সালোন’, ‘ডালচা’ (অড়হর ডালে মাংস) এবং অবশ্যই বিরিয়ানি। তুলনায় রায়লসীমার উপকূলবর্তী এলাকা অনেক বেশি ভাত-মাছ-চিংড়ি নির্ভর। হেগড়ের দাবি, তেলেঙ্গানায় কেউ হালাল মাংস ছাড়া ছোঁয় না। অন্ধ্রে এমন বাতিক নেই।
রসনা-বিতর্কে যোগ দিল চারমিনারের মদিনা সার্কেলও। সাদাব হোটেলের মেনু কার্ডে মুর্গি-মটনের বাহারি পদ। এমনকী পাকিস্তানি মটন, এপি (অন্ধ্রপ্রদেশ) মটনও পাওয়া যায়। খাদ্যরসিক অনিল রেড্ডি আদতে উপকূল অন্ধ্রের বাসিন্দা হলেও ইদানিং পাকাপাকি থাকেন হায়দরাবাদে। বললেন, “ছাড়ুন তো মশাই! অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা দু’দিকের রান্নাই এখানকার মানুষ পছন্দ করেন। রাজ্যভাগটা কোনও বাধা নয়।”
বাসনার সেরা বাসা যদি রসনা হয়, ভূগোলের বাধা রসিককে কী করে আটকাবে? আমিরপেটের হর্ষ মেস বা লকড়ি কা পুলের কাছে রায়ালসিমি রুচুলু-তে গেলে টের পাওয়া যায়, তেলেঙ্গানার মানুষ দিব্যি রায়লসীমা রান্না ভালোবেসে খাচ্ছেন। হর্ষ মেসের খদ্দের সঞ্জীব রাওয়ের কথায়, “রান্নার ঘরানার তফাৎটা বুঝতে সময় লাগে না। দুই অঞ্চলের মানুষই জানেন। রাজ্য ভাগের বিষয়টা রাজনৈতিক। সঙ্গে খানাপিনার সম্পর্ক কীসে?”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.