মাঝসমুদ্রে মাঝরাত্তিরে জাহাজের কেবিনের দরজায় ঠকঠক শব্দ। ঘুমচোখেই দরজা খুলেছিলেন ‘এমটি কটন’ জাহাজের বাঙালি ক্যাপ্টেন শিশির ওয়াহি। দেখলেন, একে-৪৭ রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই আফ্রিকান যুবক। এক পাশে হাঁটু গেড়ে বসে জাহাজের নিরাপত্তা ও নেভিগেশন অফিসার।
দুঃস্বপ্ন যে নয়, চোখ কচলে নিশ্চিত হলেন ক্যাপ্টেন। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল আতঙ্কের ঠান্ডা স্রোত। অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন বুঝেছিলেন, জাহাজের দখল নিয়েছে জলদস্যুরা। পশ্চিম আফ্রিকার গ্যাবনের নিকটবর্তী সমুদ্রে ঘটনাটি ঘটে ১৪ জুলাই।
তার পরে টানা সাত দিন জলদস্যুদের হাতেই বন্দি ছিলেন শিশিরবাবু এবং তাঁর সহকর্মীরা। ২২ জুলাই ওই জাহাজের কর্মী-অফিসারেরা মুক্তি পান। বুধবার কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফিরেছেন শিশিরবাবু। বৃহস্পতিবার আলিপুর পার্ক রোডের বাড়িতে বসে সাত দিনের বন্দিদশার কথা সংবাদমাধ্যমকে জানালেন তিনি। শিশিরবাবুর কথায়, “১৩ জুলাই গ্যাবনের জেন্টিল বন্দর থেকে মাল বোঝাই করে জাহাজ নিয়ে গ্যাবনের কাছাকাছি সমুদ্রে অপেক্ষা করছিলাম। সংস্থার পরবর্তী নির্দেশ এলে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই হানা দিল জলদস্যুরা।” ১৪ জুলাই রাতে নিজের কেবিনে ঘুমোচ্ছিলেন শিশিরবাবু। তিনি বলেন, “দরজা খুলে বেরিয়ে বুঝে গেলাম, জাহাজ জলদস্যুদের কব্জায়। দস্যুরা সঙ্গে সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল আমাকে।” |
তার পরেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাজের ‘ব্রিজ’ (যেখান থেকে জাহাজকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়)-এ। তত ক্ষণে সব কর্মীকেই ওই ব্রিজে নিয়ে আসা হয়েছে। শিশিরবাবু বলেন, “সহকর্মীদের নির্দেশ দিলাম, দস্যুদের সঙ্গে কোনও রকম বিবাদে জড়িয়ে পড়া চলবে না। নইলে হয়তো ওরা মেরেই ফেলত।” ডেক থেকেই কর্মী-অফিসারদের আলাদা আলাদা দলে ভাগ করে জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। চিফ ইঞ্জিনিয়ার-সহ চার ইঞ্জিনিয়ারকে আটকে রাখা হয় ইঞ্জিন রুমে।
ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই জনা পনেরো দস্যু গোটা জাহাজে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। কেটে দেওয়া হয় ফোন এবং স্যাটেলাইটের তার। তার পরে শিশিরবাবুর বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। ব্রিজে সব সময়েই সাত-আট জন বন্দুকধারী দস্যু পাহারা দিত তাঁকে। শৌচাগারে যেতে হলেও এক জন দস্যুকে নিয়ে যেতে হত। জাহাজের বাইরে তাকানোর ক্ষেত্রেও নিষেধ ছিল। ক্যাপ্টেন বললেন, “এক দিন টের পেলাম, কিছুটা দূর দিয়ে একটা জাহাজ যাচ্ছে। কিন্তু বিপদসঙ্কেত দেওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না।”
বন্দিদশার সাত দিনে জলদস্যুদের হরেক রূপ দেখেছেন শিশিরবাবুরা। প্রথম দু’-এক দিন তারা জাহাজের কর্মীদের অল্পবিস্তর মারধর করত। শিশিরবাবু বলেন, “জাহাজের রাঁধুনিকে দিয়েই দস্যুরা সময়ে-অসময়ে নিজেদের খুশিমতো রান্না করাত। আলাদা রান্না হত জাহাজের নাবিক-অফিসারদের জন্য।”
এ ভাবে ছ’দিন কাটার পরেই শিশিরবাবুকে ব্রিজ থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিউটি অফিসার ছাড়া নিজের নিজের কেবিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাকি কর্মী-অফিসারদেরও। শিশিরবাবু বলেন, “অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলাম, কার্গো লুঠ করে ওরা জাহাজ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে।”
তার পরে ঠিক কী ঘটেছে, তা অবশ্য আর তেমন বুঝতে পারেননি শিশিরবাবু। ২২ জুলাই রাত ২টো নাগাদ জাহাজের এক অফিসার এসে শিশিরবাবুকে জানান, দস্যুরা জাহাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে। তার পরে সবাই নিজের নিজের কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বোঝার চেষ্টা করেন, ঠিক কোন দিকে গেল দস্যুরা।
“কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও ওদের গন্তব্যের হদিস পেলাম না,” বললেন ক্যাপ্টেন ওয়াহি। শুধু বুঝেছিলেন, জাহাজের সব মালপত্র নিয়ে গিয়েছে দস্যুরা। হাতিয়ে নিয়েছে সব নাবিকের যাবতীয় মূল্যবান জিনিসপত্রও।
কোনও মতে দু’টি ফোন সারিয়ে যোগাযোগ করা হয় জাহাজের মালক সংস্থা, তুরস্কের ‘গেডেন লাইন’-এর সঙ্গে। ওই সংস্থা ঘানার টিমা বন্দরে পৌঁছতে নির্দেশ দেওয়া হয় শিশিরবাবুদের। এ ভাবেই উদ্ধার। |