নেহরু থেকে বাজপেয়ী, পৃথক তেলেঙ্গানা প্রশ্নে জেরবার সবাই
ও ইতিহাসের এক অমোঘ সমাপতন।
প্রধানমন্ত্রী জহওরলাল নেহরু চাননি। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী সি রাজাগোপালাচারী নিজেও ছিলেন পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশের ঘোরতর বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ১৯ ডিসেম্বর পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের ঘোষণা করেছিলেন নেহরু। তিনি দেখেছিলেন ’৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেসের বেশির ভাগ আসন হারানোর পিছনে ছিলেন তেলেঙ্গানার দাবিতে আন্দোলনকারী এক কংগ্রেস নেতা, সীতারাম স্বামী। ওই নেতা (যিনি পরে ধর্মগুরুতে পরিণত হয়েছিলেন) পৃথক অন্ধ্রের দাবিতে পাঁচ সপ্তাহ অনশন করেছিলেন।
আজ এত বছর পরে সেই অন্ধ্রপ্রদেশকে দু’টুকরো করার সিদ্ধান্ত নিলেন কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধী। এ বারও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে মূল কারণটি কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতি।
মাদ্রাজ থেকে অন্ধ্রকে আলাদা করার সময়ও তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়। অন্ধ্রের নেতারা মাদ্রাজ বাদ দিয়ে অন্ধ্রকে মানতে পারছিলেন না। আর তামিল নেতারা পৃথক তেলুগু রাজ্য করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তেলেঙ্গানা পৃথক রাজ্য আর তার রাজধানী হায়দরাবাদ এই প্রস্তাবটিও কিন্তু নতুন নয়। ১৯৩০ সালে দু’টি অন্ধ্র মহাসভা গঠন হয়। যার একটি ছিল তেলেঙ্গানা, অন্যটি শুধু অন্ধ্র। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও নিজাম ওসমান আলি খান হায়দরাবাদকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে চেয়েছিলেন। যা ভারত বা পাকিস্তানের অধীনে থাকবে না। ’৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে রাজা হরি সিংহের নেতৃত্বে কাশ্মীর ভারতে অন্তর্ভুক্ত হলেও হায়দরাবাদ হয়নি। ১৯৫০ সালে ভারত যখন প্রজাতন্ত্র হল তখন নিজাম ছিল রাজপ্রমুখ। ’৫১ সালের প্রথম নির্বাচনের পর হায়দরাবাদ স্টেটের প্রশাসন দেখার জন্য রামকৃষ্ণ রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার তৈরি হয়েছিল। যদিও অবিভক্ত সিপিআই তখন থেকেই তেলেঙ্গানার স্বার্থ রক্ষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
নেহরু কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশকে আলাদা রাজ্য করার পরেও সত্তার সঙ্কটজনিত সমস্যা থাকবেই। হায়দরাবাদ ও সেকেন্দরাবাদকে নিয়ে বিশাল অন্ধ্র গড়ার দাবি উঠছে। যেখানে কৃষ্ণা ও গোদাবরীর মতো দু’টি নদী থাকবে। অন্ধ্রের বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা খতিয়ে দেখতে ’৫৩ সালে নেহরু সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ফজল আলির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। তখনই কমিশন পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের কথা বলেছিল। যার মধ্যে হায়দরাবাদ থাকবে। যেখানে বেশি সংখ্যক মানুষ তেলুগুতেই কথা বলবেন। তেলেঙ্গানা তখনও শিক্ষা-অর্থ দু’দিক থেকেই পিছিয়ে। সেখানকার মানুষ ভাবতেন, অন্ধ্রের প্রভাবশালী সম্প্রদায় তাঁদের চাকরি বা অন্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। তেলেঙ্গানার দাবিতে আন্দোলন চলছে তখন থেকেই।
নেহরু ’৫৫ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথক তেলেঙ্গানার দাবি নস্যাৎ করে বিশাল অন্ধ্রের দাবি মেনে নেন। তবে তেলেঙ্গানার মানুষের প্রতি যাতে অবিচার না হয় তার জন্য ওই এলাকায় ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়েছিলেন তিনি। সরকারি চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তেলেঙ্গানার যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তেলেঙ্গানার মানুষের দুঃখ ঘোচেনি। নতুন রাজ্য গঠন হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন তাদের এলাকা থেকে কেউ মুখ্যমন্ত্রী হয়নি। ’৫৬ সালের ১ নভেম্বর যখন অন্ধ্র গঠন হয়, মুখ্যমন্ত্রী হন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। তিনি রায়লসীমার অনন্তপুর থেকে নির্বাচিত হন। সে সময়ে তেলেঙ্গানা থেকে এক জন উপ-মুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব উঠলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬০ সালে অবশ্য দামোদরন সঞ্জীবাইয়া মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তেলেঙ্গানা থেকে এক জনকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করতে বাধ্য হন।
ইন্দিরা গাঁধী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখনও তেলেঙ্গানা আন্দোলন (১৯৬৯) তীব্র হয়ে উঠেছিল। উত্তপ্ত হয় ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। হিংসা রুখতে ব্যর্থ হওয়ায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি ইস্তফা দিতে চাইলেও তা খারিজ করে অন্ধ্রে যান ইন্দিরা। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বৈঠক করে তেলেঙ্গানা অঞ্চলের বাসিন্দাদের চাকরি ও অন্য ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। সে সময় হায়দরাবাদ শহরে প্রায় ৩৫ শতাংশ মুসলমান। আর তেলেঙ্গানা এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রায় ১০ শতাংশ। কিন্তু মুসলমান সমাজ সে দিন ওই আন্দোলনে যোগ দেয়নি। বরং ব্রহ্মানন্দ রেড্ডির সঙ্গে সংখ্যালঘু সমাজের সুসম্পর্ক ছিল। এর পর ইন্দিরা ১৯৭১ সালে তেলেঙ্গানা থেকে পি ভি নরসিংহ রাওকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। এমনকী তেলেঙ্গানা প্রজা সমিতির চেন্না রেড্ডিকেও কংগ্রেসে অন্তর্ভুক্ত করার পিছনে বড় ভূমিকা নেন ইন্দিরা। পরবর্তী কালে এন টি রাম রাও থেকে চন্দ্রবাবু নায়ডু কেউই তেলেঙ্গানা আন্দোলনের পক্ষে সওয়াল করেননি। উল্টে অন্ধ্রের তেলুগুকরণে জোর দেন ওই নেতারা। সনিয়া গাঁধীর আমলে রাজশেখর রেড্ডিও ক্ষমতায় এসে অন্ধ্র ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন।
তেলেঙ্গানা ভাগে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিজাম। ২০০৮ সালের ফরচুনের সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের পাঁচটি ধনী পরিবারের মধ্যে ছিল নিজামও। ১৯৩৬ সালে নিজামের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। ফলে অন্ধ্র ভাগ হলে হায়দরাবাদ কার ভাগে পড়বে, তা নিয়ে প্রথম থেকেই সমস্যা ছিল। চন্দ্রবাবু নায়ডুও ক্ষমতায় এসে সাইবার সিটি হিসাবে গড়ে তোলেন নিজামের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হায়দরাবাদকে। ফলে রাজ্য ভাগ হলে হায়দরাবাদের মালিকানা কার হবে, তার মীমাংসা হয়নি। এমনকী এনডিএ জমানায় অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ছত্তীসগঢ়ের মতো পৃথক রাজ্য গঠন করার সিদ্ধান্ত নিলেও তেলেঙ্গানা সমস্যা মেটাতে ব্যর্থ হন। যদিও নীতিগত ভাবে বিজেপি ছোট রাজ্যের পক্ষে। তবুও হায়দরাবাদ কার ভাগে পড়বে, তা নিয়ে দ্বিমত থাকায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি বাজপেয়ী সরকার।
শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত নিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। এই ঘোষণার পরেও হায়দরাবাদ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কেন না রাজধানী স্থানান্তর হতে এখনও দশ বছর সময় লাগবে। ১৫৫ বছর দখলে রাখার পরে ব্রিটিশরা যখন চিনকে হংকং দিয়ে দেয়, তখন চিন কিন্তু সেই হংকং পেয়েও তাকে একটি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এবং সেখানকার বাণিজ্যিক গুরুত্ব মাথায় রেখে চিনের মতো দেশ পৃথক হংকং মডেল জারি রেখেছে। নেহরু থেকে সনিয়া গাঁধী— অন্ধ্রপ্রদেশের এই সত্তার রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ দেখে এখন অনেক কংগ্রেস নেতাই প্রশ্ন তুলছেন, পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য করেও হায়দরাবাদে কি একটি হংকং মডেল চালু করা যেত না? সেটাই কি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হত না?

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.