রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পাঠরতা এক ছাত্রীকে বাসস্টপ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ঘরে আটকে মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল সেখানকারই সাত পড়ুয়ার বিরুদ্ধে। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে কেটে গিয়েছে ৭২ ঘণ্টা। কিন্তু বুধবার রাত পর্যন্ত অভিযুক্তদের কাউকেই ধরতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ’জন ছাত্র ও এক ছাত্রীর বিরুদ্ধে অন্যায় ভাবে আটক, অস্ত্র দিয়ে আঘাত এবং শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করে মামলা শুরু হয়েছে। যদিও ‘নিগৃহীতা’ ছাত্রীর বাবার (পেশায় আইনজীবী) অভিযোগ, পুলিশের এফআইআর-এ অপহরণ ও খুনের চেষ্টার আইনি ধারা দেওয়া হয়নি। কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) গৌরব শর্মা অবশ্য বলেছেন, “ছাত্রীটির অভিযোগের ভিত্তিতেই মামলা হয়েছে। তদন্তও হচ্ছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, ইতিহাস-সহ কয়েকটি বিভাগের বেশ কিছু ছাত্রও বুধবার পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তোলেন। তাঁদের অভিযোগ, তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের দুই গোষ্ঠীর গোলমালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পড়ুয়াদের একাংশের অভিযোগ, ছাত্র সংসদের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর হুমকিতে অনেকে পরীক্ষা দিতে যেতে পারছেন না। ‘নিগৃহীতা’ ছাত্রীর আশঙ্কা, আজ, বৃহস্পতিবার তিনি এমএ (বাংলা) ষষ্ঠ পত্রের পরীক্ষা দিতে পারবেন না। গৌরববাবু অবশ্য দাবি করেছেন, “পড়ুয়ারা পরীক্ষা দিতে যেতে ভয় পাচ্ছেন, এমন কোনও অভিযোগ সিঁথি থানায় জমা পড়েনি।” |
‘নিগৃহীতা’ ছাত্রী এ দিন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তথা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা অলিউর মণ্ডল তাঁর পরিচিত। তাঁকে অলিউরের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকেরা মেরেছেন। তিনি আরও জানান, সিঁথি থানার পুলিশ তাঁকে শিয়ালদহ আদালতের বিচারকের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ছাত্রীটির দাবি, ‘‘পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে যা জানিয়েছি, বিচারককেও গোপন জবানবন্দিতে সবিস্তার তা-ই বলেছি। আমাকে নিগ্রহে নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা বিশ্বজিৎ দে।”
পুলিশ কেন অভিযুক্তদের ধরছে না? সিঁথি থানার পুলিশকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, বিশ্বজিৎ কলকাতা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা তৃণমূলের স্থানীয় নেতা শান্তনু সেনের ঘনিষ্ঠ। তাঁর সঙ্গীরাও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী। তাই তাঁদের গ্রেফতার করতে গড়িমসি করছেন লালবাজারের কর্তারা।
কেন নিগ্রহ করা হল ওই ছাত্রীকে? প্রধান অভিযুক্ত বিশ্বজিৎ বুধবার বলেন, “এ ব্যাপারে যা বলার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের শীর্ষ নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা বলবেন।” শঙ্কুদেব দাবি করেন, “ওই ছাত্রী ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অলিউর মণ্ডলের পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমালের ঘটনায় অলিউরকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তিনি এখন জেলে। ওই ছাত্রী আগেই হুমকি দিয়েছিলেন, অলিউরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে না নিলে তিনি মিথ্যা মামলায় বিশ্বজিৎদের ফাঁসাবেন। তিনি তা-ই করেছেন।”
তৃণমূলের স্থানীয় কাউন্সিলর শান্তনু সেন বলেন, “রবীন্দ্রভারতীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমি হস্তক্ষেপ করি না। এটা ঠিক যে, বিশ্বজিতের বাড়ি আমার ওয়ার্ডে। কিন্তু তিনি কী করেন, আমার জানা নেই। তাঁর কোনও কাজের দায়িত্বই আমি নেব না।” |
ঠিক কী ঘটেছিল ২৯ জুলাই বিকেলে? পুলিশ জানায়, ‘নিগৃহীতা’ ছাত্রী লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ পঞ্চম পত্রের পরীক্ষা দিয়ে মেসে ফেরার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের বাসস্টপে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিশ্বজিৎ দে ওরফে বাপ্পা এবং আরও ছ’জন তাঁকে ঘিরে ধরেন। বিশ্বজিৎ তাঁর চুলের মুঠি ধরেন। অন্যেরা তাঁকে চ্যাংদোলা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে নিয়ে গিয়ে ১১৩ নম্বর ঘরে জোর করে ঢুকিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। এক ছাত্রীও ওই ঘরে ঢোকেন। তাঁরা জামাকাপড় ধরে টানা-হ্যাঁচড়া করেন। তিনি প্রতিবাদ করলে বিশ্বজিৎ তাঁর গলা চেপে ধরেন। এক জন তাঁর মুখ চেপে ধরেন। তাঁকে যথেচ্ছ কিল, চড়, লাথি, ঘুষি মারা হয়। লোহার রড দিয়েও বারবার মারা হয়। তাঁর সোনার হার, আংটি, দুল এবং ব্যাগ থেকে ১৭০০ টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। বেশ কিছু ক্ষণ পরে আরও এক ছাত্র আসেন। তিনি ও বাকিরা তাঁকে ছাত্র সংসদের ঘরে নিয়ে যান। সেখানেও তাঁর উপরে শারীরিক নিপীড়ন চলে।
ওই ছাত্রী বুধবার দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অলিউরের সঙ্গে যোগাযোগের ‘অপরাধেই’ তাঁকে নিগ্রহ করা হয়েছে। তাঁর আরও অভিযোগ, ঘটনার পরে অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা আধিকারিকের কাছে এবং তার পরে উপাচার্যের ঘরে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁকে ভিতরে না ঢুকিয়ে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। নিরাপত্তা আধিকারিক উপাচার্যের ঘর থেকে বেরিয়ে অভিযোগকারিণীকে ছেড়ে দিতে বলেন। ছাত্রীটির দাবি, উপাচার্য পুরো বিষয়টি জানেন।
যদিও রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীর দাবি, ঘটনার দিন তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। তবে বুধবার সিঁথি থানার অফিসার তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন। সব্যসাচীবাবু বলেন, “পুলিশ ২৯ জুলাইয়ের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে গিয়েছে।”
|