তিন দিনের বনধ শেষ হওয়ার কথা আজ, বুধবার। দুদিন ছাড় দিয়ে শনিবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের দার্জিলিং পাহাড় বনধের ডাক দেওয়ায় পাহাড়ের নানা মহলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ দানা বাঁধছে। পাহাড়ের কয়েকশো বোর্ডিং স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। পাহাড়ের অর্থনীতির অন্যতম দুই স্তম্ভ চা ও পর্যটন-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলও চরম লোকসানের আশঙ্কা করছেন। কারণ, বর্ষার পরে পুজোর পর্যটন মরসুম শুরু হবে। পাহাড় অশান্ত হলে এক দিকে চায়ের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি, পুজোর পর্যটন ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ পাহাড়বাসী বিপাকে পড়ার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। |
উদ্বিগ্নও পাশের রাজ্য সিকিমও। দার্জিলিঙে বনধ হলে সিকিমের দিকেও বেশি পর্যটক যেতে চান না। ফলে, সিকিম সরকারের তরফেও পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে। পাহাড়ের চা, পর্যটন ও অন্যান্য ব্যবসায় যুক্ত মহলের পক্ষ থেকে বনধ না করে অন্য কোনভাবে আন্দোলন করা যায় কি না তা ভেবে দেখার জন্য মোর্চা নেতাদের অনুরোধ করেছেন। আপাতত মোর্চা নেতারা অবশ্য অবস্থান বদলানোর কোনও সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় তা দেখে মোর্চা নেতারা পদক্ষেপ করবেন বলে দল সূত্রের খবর। দার্জিলিং পাহাড়ের এই অবস্থার জন্য মোর্চা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তৃণমূলের দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে। যেমন দার্জিলিং জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অশোক ভট্টাচার্য জিটিএ-র চুক্তিপত্রকেই এদিনের অবস্থার জন্য দায়ী করেছেন। তাঁর কথায়, “আমরা শান্তি চাই। কিন্তু আমরা গোলমালের আশঙ্কা করছি।” তাঁর অভিযোগ, “এই অবস্থার জন্য পুরোপুরি তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার দায়ী। জিটিএ চুক্তিতে গোর্খাল্যান্ডের দাবির বিষয়টি মাথায় রেখে চুক্তি করা হচ্ছে বলে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যা প্রথম থেকেই আমরা বাদ দিতে বলেছিলাম। এদিন সেটাকেই সামনে রেখে গুরুঙ্গরা পাহাড়ে আন্দোলন শুরু করেছে।” |
রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর কথায়, “আদতে পাহাড়ের সমস্যা মেটাতে কংগ্রেস, বিজেপি বা তৃণমূল কেউ আন্তরিক নন। ভোটের রাজনীতিতে পাহাড়কে ব্যবহার করা হয়েছে। কোনও সময় লোকসভা, কোনও সময় বিধানসভা। আর তেলেঙ্গানার সঙ্গে দার্জিলিঙের সমস্যা আসাটা তাই স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। এখন যা করার রাজ্য সরকারকে করতে হবে।”
কার্যত একই বক্তব্য পাহাড়ের অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি’র। তিনি বলেন, “অশান্তি, আইন-শৃঙ্খলা এসব হবেই মনে হচ্ছে। পুরোটাই এখন রাজ্য সরকারের বিষয়। পুলিশ-প্রশাসন কড়া হাতে সব দমন করলে পাহাড় শান্ত থাকবে। ভোট বা রাজনীতি না ভেবে পাহাড়বাসীর স্বার্থে রাজ্যের এখন তাই করা দরকার।” মোর্চার আন্দোলনকে পুরোপুরি ‘নাটক’ বলে কটাক্ষ করেছেন প্রতাপবাবু। তিনি জানান, এদিন শুনলাম কেবলমাত্র গুরুঙ্গ পদত্যাগ করেছেন। তাও সাদা কাগজে লিখেছেন। বাকি ৪৫ জন জিটিএ সদস্য কী করবেন? এটা স্পষ্ট নয়। সবাই পদত্যাগ না করা অবধি ওঁদের কেউ বিশ্বাস করবে না। আসলে মোর্চার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। তা সামাল দিতেই গুরঙ্গ এবং তাঁর দলবল নাটক করে চলেছে। আগেও করেছেন।” |
সিপিআরএমের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অরুণ ঘাটানিও বন্ধ চান না। তিনি বলেন, “আমরা পাহাড়ে অশান্তি চাই না। তবে আলাদা রাজ্য আমরাও চাই। গণতান্ত্রিক পথে ওই আন্দোলন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। ৮০ দশকের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন পাহাড়ের মানুষ চান না।” ৮০ দশকে যাঁদের নেতৃত্বে পাহাড়ে আন্দোলন হয়েছিল সেই জিএনএলএফ ২০০৭ সালে মোর্চার উত্থানে ঝিমিয়ে পড়ে। নিজেদের সংগঠন ফের চাঙ্গা করের কাজ শুরু করেছে জিএনএলএফ। সম্প্রতি তাঁরা পাহাড়ের গ্রামে নতুন করে কমিটি তৈরিও শুরু করে দিয়েছে। এদিনের ঘটনাক্রমের পর দলের নেতাদের এখনই কোনও মন্তব্য বা রাস্তায় না নেমে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সুপ্রিমো সুবাস ঘিসিং।
রাজনৈতিক বাদানুবাদ যাই হোক না কেন? পুজোর পাহাড়ের পর্যটন মরশুম যে এবার ধাক্কা খেতে বাধ্য তা মনে করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা অনেকেই। সম্রাট সান্যাল বলেন, “অক্টোবরের শুরুতেই পুজো। বুকিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা হলে অনেকটাই ধাক্কা খাবে। আর দার্জিলিঙের পাশাপাশি সিকিমেও এর প্রভাব পড়বে।” |
ছবি তুলেছেন রবিন রাই ও বিশ্বরূপ বসাক। |