জেলা পরিষদের দখল নিলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু স্বস্তিতে থাকতে পারছে না তৃণমূল। মাত্র ৭টি পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলাপরিষদের ৪৭টি আসনের মধ্যে ২৫টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল তাদের। পাশাপাশি পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলাপরিষদে ভরাডুবি হল কংগ্রেসের। তারই সুযোগে পঞ্চায়েত সমিতিতে ২টি থেকে ৯টি করে নিল বামফ্রন্ট।
গত বারের তুলনায় এবার জেলা পরিষদে বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা কমলেও বিধানসভা ভোটের নিরিখে তা ইতিবাচক বলেই মনে করছে জেলা সিপিএম। ফলে তৃণমূল ও বামফ্রন্ট পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করতে পারলেও নদিয়া জেলা থেকে একপ্রকার হারিয়ে যেতে বসেছে কংগ্রেস। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলাপরিষদে কংগ্রেসের আসন ছিল ৫টি। তৃণমূলের ৬টি। এবার মাত্র একটি আসনে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে আর তৃণমূলের আসন বেড়ে হয়েছে ২৫।
গত বার ১৭টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে বামফ্রন্টের দখলে ছিল ২টি। এবার বেড়ে হয়েছে ৯টি। বাকি ৭টি পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছে তৃণমূল। একটি পঞ্চায়েত সমিতি ত্রিশঙ্কু হয়েছে। যদিও ১৭টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে বামফ্রন্টের দখলে থাকা ২টি পঞ্চায়েত সমিতি বাদ দিয়ে গত বার ১৫টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ৮টিতে সভাপতি পদে ছিলেন কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থীরা। বাকি পঞ্চায়েতে সভাপতি হন তৃণমূলের জয়ী প্রার্থীরা।
রানাঘাট ও কল্যাণী মহকুমার মধ্যে কেবলমাত্র হরিনঘাটায় হোঁচট খেলেও তৃণমূল পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলাপরিষদে নিজেদের দূর্গ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কৃষ্ণনগর সদর মহকুমায় অনেক জায়গায় আশানুরূপ ফল করতে না পারার পাশাপাশি তেহট্ট মহকুমায় জোর ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল। বামফ্রন্টের এই দূর্গে কোনও রকম ফাটল ধরাতে পারেনি, উল্টে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার তৃণমূলের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে তারা। হরিণঘাটা থেকে চাপড়া, নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর-২ ও তেহট্ট মহকুমার ৪টি ব্লকে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল একাধিকবার প্রকাশ্যে এসেছে। ভোটে তারই ফল ভুগতে হয়েছে দলকে।
যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “যেখানে সিপিএম ভাল ফল করেছে, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই সব এলাকার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিল কংগ্রেসের। আমাদের জেলায় কংগ্রেস সিপিএমের জোট শরিক হিসেবে কাজ করেছে। কংগ্রেসের সব ভোট সিপিএমের ব্যালটে ফেলেছে। আর তাতে কংগ্রেসকে শূন্য করে দিয়ে সিপিএম সেই জায়গা দখল করেছে। কংগ্রেসের সঙ্গে মিতালির সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে সিপিএম।”
কোথাও কোথাও সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি গোষ্ঠী কোন্দলের কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন গৌরীবাবু। তিনি বলেন, “ভোটের আগে তথাকথিত গোষ্ঠী কোন্দলের খবর পেয়েছিলাম, যা পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। ফলে যেখানে জনমতের সঠিক প্রতিফলন হয়নি, সেই সব জায়গার ময়নাতদন্ত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তা সত্ত্বেও তৃণমূল এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নদিয়া জেলায় যথেষ্ট ভাল ফল করেছে বলে বলে গৌরীবাবুর দাবি।
জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শঙ্কর সিংহের দাবি, “সিপিএমের অপেক্ষাকৃত ভাল ফলের পিছনে প্রধান কারণ বাম বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া। গত বার নদিয়া জেলায় নিজেদের মত করে জোট করে নিয়েছিলেন তৃণমূল ও কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীরা।” শঙ্করবাবু বলেন, “মূলত ভোট কাটাকুটির ফায়দা তুলেছে সিপিএম। আর কংগ্রেস যে প্রাসঙ্গিক তা আবারও প্রমাণিত হল।”
তিনটি স্তরেই কেন এত খারাপ ফল করল কংগ্রেস? শঙ্করবাবু যুক্তি, “প্রায় সাড়ে চার বছর পর নিজেদের মত করে রাস্তায় নামার সুযোগ পেল কংগ্রেস কর্মীরা। ফলে দলের সংগঠন স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বল হবে! তাতে একক ভাবে লড়াই করে ভাল ফল আশা করা যায় না।” তিনি বলেন, “বিভিন্ন এলাকার নেতৃত্ব তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় দলে শূন্যস্থান হয়েছিল, তা পূরণ করা যায়নি। এছাড়া হাঁসখালি-সহ বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের সন্ত্রাস তো রয়েছে।”
ভোটের ফল নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলের এই কাজিয়ার মধ্যে অবশ্য এ বারের ফল নিয়ে যথেষ্ট খুশি সিপিএম। আত্মবিশ্বাসীও। সিপিএমের দাবি, বিধানসভা ভোটের নিরিখে তারা এ বার ভাল ফল করেছে। তেমনি গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের থেকেও এ বার গ্রামপঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে ভাল ফল হয়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে চাপা সন্ত্রাস, রিগিং, ছাপ্পা ভোট না হলে জেলাপরিষদও দখল করত সিপিএম।
সিপিএমের জেলা কমিটির সম্পাদক সুমিত দে বলেন, “হরিণঘাটা, চাকদহ, হাঁসখালিতে সন্ত্রাস-ছাপ্পা ভোট না পড়লে আরও ৪টি আসনে আমাদের জয় নিশ্চিত ছিল। কালীগঞ্জের সন্ধ্যা রাজওয়ার মাত্র ১৭৬ ভোটে পরাজিত হয়েছে। সেখানে ভোট গণনা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। সব মিলিয়ে জেলাপরিষদে আমাদের ২৬টি আসন নিশ্চিত ছিল।” তেহট্ট ও কৃষ্ণনগর সদর মহকুমায় আশানুরূপ ফল করলেও রানাঘাট ও কল্যাণী মহকুমায় বামফ্রন্ট রীতিমত ধরাশায়ী হয়েছে। সুমিতবাবুর অবশ্য দাবি, “এর জন্য দায়ী তৃণমূলের সন্ত্রাস ও ছাপ্পা ভোট।”
|
(তথ্য সহায়তা: গৌরব বিশ্বাস, সৌমিত্র শিকদার, বিতান ভট্টাচার্য, দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়) |