মুর্শিদাবাদ যে কংগ্রেসের চেনা জমি, পঞ্চায়েতে ‘ফসল’ তুলে রাজনৈতিক মানচিত্রে তা আরও একবার স্পষ্ট করে দিল কংগ্রেস।
শুধু জেলাপরিষদ শুধু দখলই নয়, আসন সংখ্যার বিচারে চমকে দেওয়ার মত ফল করে পশ্চিমবঙ্গে কার্যত মুছে যাওয়া কংগ্রেস টিঁকেও তাকল মুর্শিদাবাদের হাত ধরে।
২০০৮ সালে মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদের মোট আসন ছিল ৬৩টি। কংগ্রেস দখল করেছিল ৩১টি। বামফ্রন্ট ৩২টি আসন পেয়ে জেলাপরিষদের বোর্ড গঠন করেছিল। এ বারের সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েতে ৭০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ছিনিয়ে নিল ৪২টি আসন। বামফ্রন্ট পেয়েছে ২৭টি।
জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ২৫৪টি। তার মধ্যে বিদায়ী বোর্ডে কংগ্রেসের দখলে ছিল ১৫২টি। বামফ্রন্টের দখলে ছিল ১০০টি। এ বার সেখানে ৩৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত খুইয়ে কংগ্রসের দখলে গিয়েছে ১১৬টি। অন্য দিকে বামফ্রন্ট এ বার দখল করেছে ১০২টি গ্রাম পঞ্চায়েত। ২৬টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে বিদায়ী বোর্ডে কংগ্রেসের দখলে ছিল ১৪টি এবং বামফ্রন্টের দখলে ছিল ১২টি। সে ক্ষেত্রে সদ্য সমাপ্ত ভোটে কংগ্রেস পেয়েছে ৯টি পঞ্চায়েত সমিতি। বামফন্ট পেয়েছে ১১টি। বাকি ৬টি ত্রিশঙ্কু। এখন প্রশ্ন, গত বারের থেকে এ বার ৩৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ৫টি পঞ্চায়েত সমিতি কম পাওয়ার পরও কি ভাবে জেলাপরিষদে গত বারের থেকে ১১টি আসন বেশি দখল করে কংগ্রেস?
সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য এ বিষয়ে দু’টি ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “প্রথমত, বামফ্রন্টকে হারাতে ৪৫-৪৬টি বুথ দখল করেছিল কংগ্রেস। তার ফলে জেলাপরিষদের ১৪-১৫টি আসনের ফলাফল প্রভাবিত হয়েছে। জঙ্গিপুর লোকসভার উপনির্বাচন ও পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল বিচার করলে দ্বিতীয় কারণটি বোঝা যায়। পঞ্চায়েত ভোটে বামফ্রন্টকে রুখতে এ জেলায় কংগ্রেসকে এক যোগে মদত দিয়েছে তৃণমূল, বিজেপি এবং এসডিপি আই। তার প্রভাব পড়ছে জেলাপরিষদে।”
অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ও রাজ্যের মন্ত্রী তথা এ জেলার তৃণমূল নেতা সুব্রত সাহা। অধীর বলেন, “মানুষ উন্নয়ন চায়। উন্নয়নের বদলে দুর্নীতি যেখানে হয়েছে সেখানেই মানুষ ভোটের রায়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন জনপ্রতিনিধিদের দলকে শাস্তি দিয়েছেন। তার ফলে আমাদের দখলে থাকা বেশ কিছু পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি হাতছাড়া হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলাপরিষদসব ক্ষেত্রেই বিগত ৫ বছরের উন্নয়নের বিচার করেই মানুষ ওই রায় দিয়েছেন। এটা খুব ভাল লক্ষণ।”
রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের জেলানেতা সুব্রত সাহা অবশ্য এ জেলার পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরের ভিন্ন ভিন্ন ফলাফলের বিষয়ে অস্বাভাবিকতা দেখছেন না। তিনি বলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়পরাজয় নির্দ্ধারিত হয়। এবং একটি-দু’টি আসনের তফাতে বোর্ড কার দখলে যাবে সেটিও নির্দ্ধারিত হয়। কিন্তু জেলা পরিষদের ক্ষেত্রটি বিশাল। তখন গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির বেশ কিছু আসনের বিজয়ী ও বিজিত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের যোগফল জেলা পরিষদের আসনের অন্য ফলাফল তৈরি করে। ” মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের কিছুটা প্রমাণ মেলে জেলার গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসন দখলের পরিসংখ্যান থেকে।
মুর্শিদাবাদ জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসন সংখ্যা ৪২৪৭টি। তার মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ১৯১৮টি। বামফ্রন্ট পেয়েছে ১৫৪৪টি। অর্থাৎ বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত খুইয়েও কংগ্রেস কিন্তু বামফ্রন্টের থেকে ৩৭৪টি আসন বেশি পেয়েছে। ফের বামফ্রন্টের থেকে ৫টি পঞ্চায়েত সমিতি কম পাওয়ার পরও কংগ্রেস কিন্তু গোটা জেলার আসন সংখ্যার বিচারে বামফ্রন্ট্রের থেকে ৬টি আসন বেশি পেয়েছে। ওই ব্যখ্যা ছাড়াও জেলাপরিষদে কংগ্রেসের চমকপ্রদ ফলাফলের নেপথ্যের কারণ হিসাবে অন্য একটি ব্যাখাও উঠে এসেছে। তা হল, বাম বিরোধী থতা ডানপন্থী ভোট গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে যে ভাবে বিভিন্ন দলের পকেটে বিভক্ত হয়, জেলাপরিষদের ভোটের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। সুতি ১ নম্বর ব্লকের কথাই ধরা যাক। সেখানে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে তৃণমূলের প্রার্থী, কংগ্রেসের প্রার্থী ও বিক্ষুব্ধ প্রার্থীর মধ্যে ডানপন্থী ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় ৬টির মধ্যে মাত্র একটি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে কংগ্রেস। কিন্তু জেলাপরিষদের ক্ষেত্রে ডানপন্থী ভোট ভাগাভাগি হয়নি। ফলে সেখানে ওই ব্লকের জেলাপরিষদের দু’টি আসনই পেয়েছে কংগ্রেস।
|
(তথ্য সহায়তা: শুভাশিস সৈয়দ ও বিমান হাজরা) |