|
|
|
|
জিতেও উদ্বেগে তৃণমূল |
পূর্বে বহু পঞ্চায়েতে ইন্দ্রপতন |
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্য জুড়ে ঘাসফুল ফুটেছে। পূর্ব মেদিনীপুরেও তৃণমূলেরই জয়জয়কার। কিন্তু তারই মধ্যে অশনি সঙ্কেতজেলার বেশ কিছু পঞ্চায়েতে হেরে গিয়েছেন তৃণমূল প্রধানরা। কোলাঘাট পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, নন্দকুমারের বাবুলাল মণ্ডল ও এগরা ২ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি প্রকাশ রায়চৌধুরীও নিজের কেন্দ্রেই হেরে গিয়েছেন।
গত পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর কী প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার শিকার প্রধানরা? না দুর্নীতি, পক্ষপাতের যে অভিযোগ উঠেছে বারেবারে, তারই জের পঞ্চায়েত ভোটের ফলে। স্পষ্ট জবাব মেলেনি তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে। যেখানেই হেরেছেন, সেখানেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা বলে দায় এড়াতে চেয়েছেন তাঁরা। জেলার এক তৃণমূল নেতা অবশ্য মেনে নেন, “বেশ কিছু পঞ্চায়েতে প্রধানদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে বারেবারে। দল ব্যবস্থা নিতে না পারলেও সুযোগ বুঝে জনতা ছুড়ে ফেলেছে তাঁদের।” তবে, তিনি এ-ও মনে করিয়ে দেন, “ওই সব পঞ্চায়েতের অধিকাংশই দখলে রাখতে পেরেছে তৃণমূল। যা প্রমাণ করে সামগ্রিক ভাবে দলে এখনও আস্থা হারাননি জেলাবাসী।”
এ বার পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের ৬০টি আসনের মধ্যে ৫৪টিতে জিতে একক ভাবে ক্ষমতায় আসতে চলেছে তৃণমূল। জেলার ২৫টা পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ২৪টিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা। তবে, তাদের দখলে থাকা পঞ্চায়েতের সংখ্যা ১৬৪ থেকে কমে হল ১৫৭। বামফ্রন্ট জিতেছে ৪৩টি পঞ্চায়েতে (আগে ছিল ৫৬)। ২০০৮ সালের ফলের নিরিখে তৃণমূলের উন্নতিই হয়েছে বলতে হয়। কারণ, গত বার পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা পরিষদের আসন ছিল ৫৩। এর মধ্যে তৃণমূল জিতেছিল ৩৫টি আসনে। জোটসঙ্গী এসইউসি ১। বামফ্রন্ট পেয়েছিল ১৭টি আসন। পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে তৃণমূল পেয়েছিল ২০টি, বামেরা ৫।
সাফল্যের এই পরিসংখ্যানের ভিতরে ঢুকলে বেরিয়ে আসছে উদ্বেগের কিছু সূত্র। কারণ, বেশ কিছু পঞ্চায়েতের প্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হেরে গিয়েছেন এ বারের ভোটে। যেমন, হলদিয়ার সুতাহাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি অমিয় কুমার দাস এবার হেরে গিয়েছেন। উল্লেখ্য, জেলায় সুতাহাটা পঞ্চায়েত সমিতিই একমাত্র তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে। সুতাহাটার কুকড়াহাটি পঞ্চায়েত প্রধান কল্পনা দাস, আশদতলিয়া পঞ্চায়েত প্রধান অরুণ মাভৈ পঞ্চায়েত সমিতির আসনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছেন। সুতাহাটার পঞ্চায়েত সমিতির একটি আসনে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলেন জেলা পরিষদের বিদায়ী স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ রফিকুল হাসান। তিনিও হেরে গিয়েছেন। অন্য দিকে, মহিষাদল ব্লকের অমৃতবেড়িয়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান দীপা পণ্ডা, নাটশাল ২ পঞ্চায়েত প্রধান আহমেদ আলি, কিসমত নাইকুণ্ডির প্রধান দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীরা এ বার হেরে গিয়েছেন।
২০০৮ সালে জমি রক্ষা আন্দোলনের জোয়ারে নন্দীগ্রামে তৃণমূলের বিপুল জয় হয়েছিল। জেলায় তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি সেই নন্দীগ্রাম ১ ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে একাধিক জায়গায় হেরে গিয়েছেন তৃণমূলের প্রধান। সামসাবাদ পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান শেখ খুশনবি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে হারের মুখ দেখতে হয়েছে। তাঁর দাবি, “দলের একাংশের চক্রান্তের কারণে আমায় হারতে হয়েছে।” নন্দীগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মানিকলাল জানাও হেরে গিয়েছেন। তাঁদের হারের কারণ নিয়ে নন্দীগ্রামের তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ান বলেন, “দলীয় কোন্দলের কারণেই নন্দীগ্রামের প্রধান হেরেছেন। আর স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্কে ঘাটতির কারণে সামসাবাদের প্রধান হেরেছেন। এ ছাড়াও কিছু স্থানীয় সমস্যা ছিলই।”
কোলাঘাট ব্লকে তৃণমূলের দখলে থাকা আমলহাণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান খাদেবুল ইসলাম, বৃন্দাবনচক গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মদন ঘাঁটা এ বার হেরে গিয়েছেন। একই ভাবে ওই ব্লকের সিদ্ধা ১ পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান সজল মাইতি এ বার পঞ্চায়েত সমিতির আসনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছেন। কোলা ১ পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান চৈতালি ঘোষ এ বার দলের টিকিট না পেয়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু হালে পানি পাননি তিনিও। নন্দকুমার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বাবুলাল মণ্ডলও হেরে গিয়েছেন। বাবুলালবাবু বলেন, “দলের এক পঞ্চায়েত সদস্য নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোট কাটায় আমাকে হারতে হল।” এলাকার বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা তথা বিদায়ী পঞ্চায়েত সমিতির বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ আলম অবশ্য বাবুলালের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরাসরি। তিনি বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতি পরিচালনায় ব্যর্থতা ছিল। দলের পুরনো কর্মীদের বাদ দিয়ে নতুনদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল। কর্মী-সমর্থকরা তা ভাল চোখে দেখেননি।”
হেরে গিয়েছেন, কোলাঘাট পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এই প্রসঙ্গে কোলাঘাটের তৃণমূল বিধায়ক বিপ্লব রায়চৌধুরী বলেন, “দলেরই একাংশের বিরোধিতার কারণে অসিতবাবুর হেরে গিয়েছেন। দলের বিক্ষুদ্ধরা নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে ভোট কেটেছেন।”
প্রধানদের হারের কারণ জানতে চাইলে অবশ্য বিপ্লববাবু মেনে নেন, “কিছু ক্ষেত্রে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ ও কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া হারের কারণ। এই রায়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ পঞ্চায়েত পদাধিকারীদের প্রতি সতর্কতামূলক বার্তা দিয়েছে। ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এটা জনগণের ইতিবাচক পদক্ষেপ।” |
|
|
|
|
|