|
|
|
|
সুতাহাটায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ‘কাল’ হল তৃণমূলের |
দেবমাল্য বাগচি • সুতাহাটা |
অভাবনীয় পতন বলা চলে। সুতাহাটায় পঞ্চায়েত ভোটের ত্রিস্তরেই শাসকদলকে পর্যুদস্ত করল বামেরা। স্বাভাবিক ভাবেই ঘাসফুলের দুর্গে তৃণমূলের এই ফলাফলে আলোড়ন পড়েছে রাজনৈতিক মহলে। পরাজয়ের কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
পূর্ব মেদিনীপুরের শিল্পশহর ঘেষা সুতাহাটায় ৬টির মধ্যে তিনটি পঞ্চায়েতেই এ বার জিতেছে বামেরা, আসনের হিসাব ধরলে ৮৯টার মধ্যে ৫৬টিতে। বাকি দু’টি পঞ্চায়েতে জিতে দু’নম্বরে তৃণমূল। একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। সুতাহাটা পঞ্চায়েত সমিতিতেও এ বার ১৬টি আসনের মধ্যে ১১টি দখল করে বোর্ড গড়তে চলেছে বামেরা। জেলা পরিষদে দু’টি আসন ছিল। দু’টিতেই জিতেছে তারা। অথচ, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে গোটা জেলার সঙ্গেই এই ব্লকেও এসেছিল অভাবনীয় সাফল্য। জেলা পরিষদের দু’টি আসন-সহ পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল। ৬টি পঞ্চায়েতেও ক্ষমতা দখল করেছিল তারা। আসনের হিসাব ধরলে ২০০৮-এ ৭২টির মধ্যে ৫৪টিতে তৃণমূল ১৭টিতে বাম ও একটিতে বিজেপি জিতেছিল। শুধু তাই নয়, লোকসভা, বিধানসভা ভোটেও তৃণমূলের খাসতালুক হয়ে উঠেছিল সুতাহাটা ব্লক।
এ বার পাশা ওল্টাল কেন?
রাজনৈতিক মহলের আলোচনায় সবার উপরে উঠে এসেছে যে কারণটি, সেটি হল তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। একটি-দু’টি গোষ্ঠী নয়, বহু শাখা ও উপদলীয় গোষ্ঠী রয়েছে এই এলাকায়। প্রথমত স্থানীয় বিধায়ক শিউলি সাহার সঙ্গে স্থানীয় সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর বিরোধযা সামনে এসেছিল হলদিয়া পুরভোটে। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও তাই এলাকায় কোনও ভূমিকাতেই দেখা যায়নি শিউলিদেবীকে। এ ছাড়াও রয়েছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নেতা কমলেশ চক্রবর্তী ও প্রাক্তন বিধায়ক তুষার মণ্ডলের গোষ্ঠী। রয়েছে আনন্দময় অধিকারীর অনুগামীরা।
২০০৮ সালে জেলা পরিষদের ২৪ নম্বর আসনে এলাকার হেভিওয়েট সিপিএম নেতা শ্যামল মণ্ডলকে হারিয়ে জিতেছিলেন আনন্দময় অধিকারী। এ বারও তিনি ওই আসনের জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন। কিন্তু দল প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করে শিক্ষক নেতা কমলেশবাবুকে। পরে আনন্দময়বাবু মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলেও কাঁটা ওঠেনি। কমলেশবাবুর হার তাই প্রত্যাশিতই ছিল অনেকের কাছে।
মজার কথা হল, আনন্দময়বাবু যাঁকে হারিয়েছিলেন, সেই শ্যামলবাবুই এ বার হারিয়েছেন কমলেশবাবুকে।
এ দিকে, বাকি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে এ বার প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন তুষার মণ্ডল। মনোনয়ন না পেয়ে তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশই বেড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “পুরভোটের একটি ওয়ার্ডে যে জিততে পারে না, সেই তুষারবাবুর কাঁধে দেওয়া হয়েছে ব্লকের দায়িত্ব। এই ফলাফল তাই আমাদের অবাক করছে না।” প্রাক্তন বিধায়ক তুষারবাবুর মতে, ‘দলের মধ্যে থেকে কেউ কেউ ব্যক্তি স্বার্থ দেখা’য় অপ্রত্যাশিত এই পরাজয়। কার দিকে ইঙ্গিত করছেন, স্পষ্ট ভাবে জানাননি তুষারবাবু। তবে রাখঢাক না করেই আনন্দময়বাবু বলে দেন, “ফল যে খারাপ হবে বুঝেছিলাম। তবে এতটা খারাপ হবে ভাবিনি। যাঁরা টিকিট বিলি করেছেন তাঁরা কৈফিয়ত দেবেন। হারাধনদের দল থেকে বের করতে হবে।” নেতাদের এই বক্রোক্তিই প্রমাণ করিয়ে দেয় অন্তর্দ্বন্দ্বের গভীরতা। স্বাভাবিক ভাবেই বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের অনেকেই নির্দল হিসাবে ভোট কেটেছেন ভাল। মাঝ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে বামেরা।
তবে বামেদের পক্ষেও প্রচুর ভোট পড়েছে। সাফল্যের রসায়ন জানতে গেলে প্রথমেই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের আগে সুতাহাটায় বামেদের ভালই জনসমর্থন ছিল। এই ব্লকের ৬টির মধ্যে ৫টিতেই ক্ষমতাসীন ছিল তারা। পুরনো সেই সমর্থকদের সমর্থন এ বার গিয়েছে বামেদের পক্ষে। এ ছাড়া শিল্পশহরে তৃণমূলের ‘মেজ-সেজ’ দাদাদের দাপটে বিরক্ত শ্রমিকদের একাংশ। তাঁদের অনেকেই পাশের এই এলাকার ভোটার। সেই ভোটও গিয়েছে বামেদের ঝুলিতে। সম্প্রতি হলদিয়া বন্দরের পণ্য খালাসকারী সংস্থা এবিজি বিদায়ের জন্য আঙুল উঠেছে তৃণমূলের দিকে। কাজহারা শ্রমিকদের একাংশ এই সুতাহাটাতেই এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের কেউ কেউ আবার পঞ্চায়েতে প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূল বিরোধী প্রচার চলছে সমানে। সিপিএমের জোনাল সম্পাদক সুদর্শন মান্না বলেন, “সর্বত্র একটা চাপা সন্ত্রাস কাজ করেছে। হলদিয়া সংলগ্ন এই এলাকায় শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নেওয়া মেনে নিতে পারেননি মানুষ।” প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের দাবি, “তৃণমূলের ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রভাব পড়েছে ভোটে। মানুষ আমাদের উপরে আস্থা রেখেছে।” |
|
|
|
|
|