|
|
|
|
এক লাফে ‘ফার্স্ট বয়’, ঘোর কাটছে না তৃণমূলের |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
শুধু কেশপুর-গড়বেতা নয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সারা জেলা জুড়েই সিপিএম যে এ ভাবে কোণঠাসা হবে তা ভাবতে পারেনি শাসক তৃণমূলও!
মঙ্গলবার দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১২টা বেজে ১০। ফেডারেশন হলের পুব দিকের ছোট্ট ঘরটায় খাটে বসে একের পর এক জয়ী জেলা পরিষদ প্রার্থীদের ফোন করে চলেছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়। বলছেন, “সকলকে নিয়ে কাজ করতে হবে। যা করবেন, স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে করবেন।” তখনই মোবাইল বেজে উঠল। ফোন ধরে দীনেনবাবু বলে উঠলেন, “সেই ১৯৯২ সাল থেকে তোমার নিরলস পরিশ্রম-চেষ্টা। আজ ফল পেলাম। দাদা, আমরা তোমাকে ভুলব না।” ফোনের ও প্রান্তে সুব্রত বক্সী, সাংসদ তথা তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি। কিছু পরে দলের এক নেতা জেলা সভাপতিকে বলে গেলেন, “সত্যি, এতটা ভাল ফল হবে বলে ভাবিনি। যেন ম্যাজিক। আমরা ছিলাম লাস্ট বয়। হয়ে গেলাম ফার্স্ট বয়!” দীনেনবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর, “আমি কিন্তু জানতাম এমন ফলই হবে।” |
|
তৃণমূল জেলা সভাপতি দীনেন রায়কে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন সমর্থকরা। |
ফল খারাপের ইঙ্গিত ছিল বামেদের কাছেও। তবে এতটা খারাপ ফল কেউই আশা করেননি। এই আকালেয়ও জেলা পরিষদ থেকে জেতা সিপিএম প্রার্থী রীতা জানা তাই স্বীকার করছেন, “দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে অনেকটা আত্মকেন্দ্রিকতা এসে গিয়েছিল। এসেছিল আত্মসন্তুষ্টিও। সকলেই ধরে নিচ্ছিলেন, ওরা তো আমাদেরই। তাই সকলের কাছে যাওয়া, খোঁজ রাখা, এ সবে খামতি দেখা দিতে থাকে। তাতেই মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জন্মায়।” সেই ক্ষোভই ধরা পড়েছে ভোটের বাক্সে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ৬৭টি জেলা পরিষদের আসনের মধ্যে শাসক দল তৃণমূল পেয়েছে ৬৪টি। সিপিএম পেয়েছে ২টি ও কংগ্রেস এক! একই কথা জেলা পরিষদ থেকে জিতে আসা কংগ্রেস প্রার্থী বিকাশ ভুঁইয়ারও। যিনিও সন্ত্রাস থেকে শুরু করে বিধানসভায় তৃণমূলের সঙ্গে জোটের কারনে দলের ক্ষতি হওয়ার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। তারই সঙ্গে একথাও জানাতে ভোলেননি, “সংগঠনটাও আমাদের দুর্বল। সংগঠনকে আরও চাঙ্গা করতে হবে।” |
|
পিংলায় জেলা পরিষদে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী অজিত মাইতির বিজয় মিছিল। |
কংগ্রেসের সংগঠন প্রথম থেকেই দুর্বল। কিন্তু বামফ্রন্টের তো সংগঠন আগের মতোই রয়েছে। তবু এই হাল কেন? বিভিন্ন স্তরে নির্বাচনে জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের কথায়, “কী ভাবে জয় আসবে। নিজেদের কর্মীরাই এখন সাহস করে প্রচারে যেতে চাইছে না। যদি কেউ দেখে ফেলে। অতি ঘনিষ্ঠ সমর্থকের বাড়িতেও ভোট চাইতে যেতে পারিনি। আগে থেকেই ফোনে বারণ করে দিয়েছে। কারণ, যাওয়ার পর সেই বাড়িতে আক্রমণ হতে পারে।” কিন্তু কেন এমনটা হল? তাঁদের কথায়, “বামফ্রন্টের সময়েও আমাদের দলের কিছু কর্মী-সমর্থক তো ভুল করেছিল। এখন তারই মাসুল দিতে হচ্ছে।” তবে এবার দল যাতে তাঁদের কথাও শোনে সে ব্যাপারে দাবি জাাননোর কথাও ভাবছেন সকলে। তাঁদের কথায়, “আমরাই তৃণমূল স্তরে কাজ করি। দলীয় নেতৃত্বের কথা যেমন শুনব, তেমনি আমাদের কথাও দলকে শুনতে হবে। নাহলে এই ঘটনার পরিবর্তন ঘটবে না।”
এক দিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে বামফ্রন্ট নেতৃত্বের আত্মতুষ্টি, কিছু নেতার খারাপ আচরণ, তাই ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার ২ বছরের মধ্যেই মনে ভীতি, অন্য দিকে কংগ্রেস-সহ অন্য আঞ্চলিক দলগুলির দুর্বল সংগঠন - এই কারনেই তৃণমূল যে সব্বাইকে একেবারে পিছনে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জেলা পরিষদে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী তথা দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি নির্মল ঘোষও স্বীকার করেন যে, “এতটা অভাবনীয় ফল হবে বলে আমরাও ভাবতে পারিনি। কিন্তু মানুষ অশান্তি চাই না। সশস্ত্র মাওবাদী যেমন চায় না, সশস্ত্র সিপিএমের হার্মাদও চায় না। সবাইকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তি ফিরিয়েছেন। তারই প্রভাব পড়েছে ভোটের বাক্সে।” সব মিলিয়ে তাই পঞ্চায়েতের ফল এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে হাজারো সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিরোধীরা যা ফল করতে পারত, এবার সংগঠিত দল বামফ্রন্টও তা করতে পারেনি। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল ২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করতে পেরেছিল। দখল করেছিল একটি পঞ্চায়েত সমিতিও! জেলা পরিষদে তৃণমূলের ৩ জন প্রার্থী জয়ী হয়েছিল। এবার বামফ্রন্ট মাত্র ২১টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করতে পেরেছে। একটিও পঞ্চায়েত সমিতির দখল নিতে পারেনি। জেলা পরিষদে ২ জন প্রার্থী জয়লাভ করেছে। পঞ্চায়েতে বিরোধীদের অংশগ্রহণ না করলে কী সত্যিই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব? বিরোধিতা না থাকলে তো স্বেচ্ছাচারিতা আসতে পারে? আর তখনই ধাক্কা খাবে উন্নয়ন। এ বার আবার মহিলাদের অংশগ্রহণ রয়েছে ৫০ শতাংশ। এক্ষেত্রে কী ভাবে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে? আদৌ কী তা সম্ভব? সিপিএমের জেলা পরিষদ সদস্য রীতাদেবীর কথায়, “আমরা পূর্ণ সহযোগিতা করব। আবার অস্বচ্ছতা দেখলে তীব্র প্রতিবাদও করব।” একই কথা বিকাশবাবুরও। তাঁর কথায়, “ভাল কাজে সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। খারাপ কিছু দেখলেই প্রতিবাদ জানাব।” আর তৃণমূলের নির্মলবাবুর কথায়, “আমাদের একমাত্র লক্ষ্য উন্নয়ন। অনেক যুবক-যুবতী এসেছে। যাঁদের মধ্যে কাজ করার দক্ষতা রয়েছে, সক্ষমতা রয়েছে। তাঁদের দিয়েই উন্নয়নে নজির গড়তে চাই।” |
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|