হুগলিতে সাড়ে তিন দশকের ‘বাম ম্যাজিক’ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে কার্যত উধাও হয়ে গেল। জেলা সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য তৃণমূলের এই জয়ের নেপথ্যে সন্ত্রাসেরই বড় ভূমিকা আছে বলে ব্যাখ্যা করছেন। অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, বিধানসভা দখলের পরে পঞ্চায়েত ভোটের ফলে রাজ্যজয়ের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
এ বারের নির্বাচনে জেলা পরিষদের ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৫টি পকেটে পুরেছে তৃণমূল। ১৮টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে তৃণমূলের দখলে এসেছে ১৫টি। হুগলিতে ১৮টি ব্লকের মধ্যে দু’টি (পাণ্ডুয়া এবং বলাগড়) বাদে সব কটি’তেই এ বারেও তৃণমূলের জয়জয়কার। ২০৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৫৯টিতে নিরঙ্কুশ ভাবে ক্ষমতা পেয়েছে তারা। সেখানে বামেরা দখলে রাখতে পেরেছে মাত্র ৩৬টি পঞ্চায়েত। আরামবাগের মলয়পুর পঞ্চায়েতে নির্দলেরা সংখ্যায় ভারি। বাকি ১১টি পঞ্চায়েত অমীমাংসিত রয়েছে।
২০০৮ সালের পঞ্চায়েতে ছিল কার্যত উল্টো চিত্র। জেলার ৪টি মহকুমাতেই (বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বাদে) বামেরা নিজেদের গড় ভাল মতোই ধরে রেখেছিল। আরামবাগ, চুঁচুড়া সদর, চন্দননগর এবং শ্রীরামপুর চার মহকুমাতেই সার্বিক ভাবে ক্ষমতার রাশ সিপিএমের হাতেই ছিল। জেলায় বিরোধী তৃণমূল যখন সংগঠনে কার্যত হালে পানি পাচ্ছে না, ২০০৬ সালে বাম সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা গড়ার। সরকারের এই সিদ্ধান্তে গর্জে ওঠে সিঙ্গুর। মূলত প্রস্তাবিত ওই কারখানার জন্য যে তিনটি পঞ্চায়েতকে কেন্দ্র করে জমি অধিগ্রহণের কথা ছিল, সেই এলাকার মানুষ ফুঁসে ওঠেন সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। প্রতিবাদী গ্রামবাসীদের সঙ্গে জুড়ে যান তৃণমূল নেতৃত্বও। আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগে।
মূলত এই হাওয়ার ভরসাতে শুধু এই জেলায় নয়, গোটা রাজ্যেই তৃণমূল নতুন অক্সিজেন পেয়ে যায়। যে আন্দোলনকে হাতিয়ার করে লালবাড়ির ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে যান তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিঙ্গুর ব্লকের ১৬টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৫টিরই দখল নেয় তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদেও উল্লেখযোগ্য ভাল ফল করে তারা। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে যেটুকু অধরা ছিল, এ বার তা-ও হাতের মুঠোয় চলে এল তৃণমূলের।
জেলা সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য এই জয়ের বড় কারণ ঠাওরেছেন সন্ত্রাসকেই। দলের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার দিন থেকেই সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে তৃণমূলের বাহিনী। জেতার পরেও পোলবায় আমাদের পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার। তার ফলে সন্ত্রাস লাগামছাড়া হয়েছে।”
সুদর্শনবাবুর সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের হুগলি জেলা কার্যকরী সভাপতি দিলীপ যাদবের বক্তব্য, “আমরা যদি সন্ত্রাসই করব, তা হলে পাণ্ডুয়ায় ওরা অত আসন কী ভাবে পেল? বলাগড়, চণ্ডীতলাতেই বা কী ভাবে আমাদের তুলনায় এগিয়ে রইল? আসলে মিথ্যা বলার ধারাবাহিকতা ওরা ছাড়তে পারেননি। এই মিথ্যাচারের জন্যই তো মানুষ ওদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।”
দলের সংগঠন যেখানে মজবুত সেখানে ফল ভাল হয়েছে, এই যুক্তি মানতে নারাজ সিপিএমের জেলা সম্পাদক। তাঁর কথায়, “হরিপালের ফল আমাদের কাছে বিস্ময়কর। পোলবা-দাদপুরেও আমাদের ফল ভাল হয়নি। আসলে ওই সব এলাকায় তৃণমূলের সন্ত্রাসের কাছে আমাদের সংগঠন কাজে আসেনি।” হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী বেচারাম মান্না বলেন, “সুদর্শনবাবুরা আর কত মিথ্যার বুলি আওড়াবেন? পাণ্ডুয়ায় ওঁরা জিতলে বিস্ময়কর হয় না, আর হরিপালে আমরা জিতলে সেটা বিস্ময়কর?”
জেলার নেতারা জোর গলায় নিজেদের ফলের কথা বললেও তীব্র গোষ্ঠীকোন্দল তাঁরা ঠেকাতে পারেননি। আর তার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন জাঙ্গিপাড়ার ফুরফুরা থেকে নৈটি, নবগ্রাম থেকে রঘুনাথপুর, পাণ্ডুয়া থেকে বলাগড়ে, সিঙ্গুর, আরামবাগ সর্বত্রই দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোথাও চেয়ার, কোথাও আম, কোথাও নারকেল গাছ চিহ্নে দাঁড়িয়ে পড়েছে তৃণমূলেরই গোঁজ।
অনিবার্য ভাবেই ওই সমস্ত জায়গাতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে তৃণমূলের বিজয়রথ। বাম জমানায় শেষ তিন বার সিপিএম শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া ব্লকের রঘুনাথপুর পঞ্চায়েতে যেখানে খাতা খুলতে পারেনি, সেখানে এ বার তৃণমূলকে হারিয়ে পঞ্চায়েতটি দখল করেছে তারা। অপ্রত্যাশিত জয়ের পরে সেখানকার ডিওয়াইএফ নেতা পার্থ ময়রা গণনাকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বলেই ফেলেন, “পঞ্চায়েতের ক্ষমতা মানুষ আমাদের দেবেন, ভাবিনি। আমাদের ঘরে লাল আবির কেনা নেই। বাড়ি ফিরে কিনতে হবে।”
জেলার সার্বিক ফলাফলের নিরিখে জেলা সিপিএম নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য তৃণমূলের সন্ত্রাসের পাশাপাশি নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং এ বারের পঞ্চায়েতে দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা (বর্তমানে বহিষ্কৃত) অনিল বসুর অনুপস্থিতিকেও কারণ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, এই দুই কারণেই আরামবাগ মহকুমা-সহ জেলার বিস্তীর্ণ অংশে সিপিএমের ফল খারাপ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে অবশ্য জেলা সিপিএমের বর্তমানে ক্ষমতাসীন নেতারা কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
পঞ্চায়েতের সামগ্রিক ফলে কংগ্রেসের ফল শোচনীয়। ধনেখালিতে পঞ্চায়েত আসনে মনুজা বিবির জয়ই তাদের একমাত্র স্বান্তনা। বিজেপিও জেলায় দাঁত ফোঁটাতে পারেনি।
|