প্রবন্ধ ২...
সমস্যা আছে বলে খাবার দেওয়া যাবে না?
ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার একটি গ্রামে ২০০৯ সালে অভিভাবকদের সঙ্গে মিড-ডে মিলের প্রয়োজন, উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। হঠাৎ মার কোল ঘেঁষে বসে থাকা তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্র বলে উঠল, ‘আমাদের স্কুলের দেওয়ালে ভাল ভাল খাবারের নাম লেখা আছে, তা-ও প্রতিদিন আমাদের খেতে দেয় না। যে দিন রান্না হয়, সে দিন শুধু খিচুড়ি বা ভাত আর আলুর ঝোল দেয়। দিদিমণিরা সব টাকা চুরি করে নেয়।’ বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি যে, অভিভাকদের মতামত এ ভাবেই প্রতিফলিত হল শিশুটির মুখে। পাকুড় জেলায় ভাতের বদলে দশ পয়সার লজেন্স দেওয়া বন্ধ করতে পারেননি পাথরখাদানে কাজ করা মায়েরা। পশ্চিমবঙ্গে লজেন্স দেওয়ার ঘটনা চোখে পড়েনি বটে, কিন্তু কানা বেগুন, পচা আলুর ঝোল বা পচা গন্ধওয়ালা ভাতের অভিযোগ শুনি না বা দেখি না, তা নয়।
মিড-ডে মিল নিয়ে নানা সমস্যা বা অভিযোগ আপার প্রাইমারি স্কুলের তুলনায় প্রাথমিক স্কুল ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে অনেক বেশি। চালের গুণমান নিয়ে যত অভিযোগ, তুলনায় চালের পরিমাণ নিয়ে অভিযোগ অনেক কম। এর প্রধান কারণ, স্কুলে চালের বরাদ্দ স্থির হয় এনরোলমেন্ট বা মোট পড়ুয়ার সংখ্যা অনুসারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফল্স এনরোলমেন্ট অর্থাৎ মোট পড়ুয়ার সংখ্যা বেশি দেখানোর ফলে মাথাপিছু চালের বরাদ্দ বাড়ে। কিন্তু মিড-ডে মিল চালানোর জন্য অর্থের জোগান নির্ধারিত হয় ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতির ভিত্তিতে। উপস্থিতি কম থাকলে সেটা কিছুটা বেশি করে দেখালেও বরাদ্দ কমে যায়, ফলে মিড-ডে মিলের গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আপার প্রাইমারি স্কুলগুলিতে গড় উপস্থিতির হার বেশি হওয়ায় শিশুর পাতে একটা সব্জি বা ডাল দেওয়া যতটা সম্ভব, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র বা প্রাথমিক স্কুলগুলির ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব।
প্রাইমারি স্কুলগুলিতে উপস্থিতি কম হওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে বেসরকারি স্কুলের প্রতি অভিভাবকদের আস্থা ও আগ্রহ। শহর বা গঞ্জ এলাকার লাগোয়া গ্রামগুলিতে যে অভিভাবকের সামান্য আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাঁরা সাইকেলে বা মোটরসাইকেলে করে বাচ্চাকে পৌঁছে দিচ্ছেন বেসরকারি স্কুলে। কোথাও কোথাও আবার গ্রামের মধ্যেই দরমার বেড়া দেওয়া কাঁচা মাটির এবড়োখেবড়ো মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে চলছে বেসরকারি স্কুল। এর ফলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়ার ঘাটতি বা অনুপস্থিতিকে অনিবার্য করে তোলে। গত তিন-চার মাসে পুরুলিয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার বহু স্কুলে মোট ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ২২, ২৪ এমনকী ১০-ও চোখে পড়েছে! পুরুলিয়া জেলার জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী গ্রামের স্কুলগুলিতে মোট ২০ বা ২২ জন ছাত্রছাত্রী হয়তো খুব অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম সাগরদিঘির মতো ব্লকগুলিতেও এমনটা চোখে পড়ে।
আমরা যা পারি। সাঁইথিয়া, বীরভূম। ছবি: অনির্বাণ সেন
একেবারে ভিতরের দিকে গ্রামগুলোতে শিশুকে বেসরকারি স্কুলে পাঠানোর সুযোগ নেই, কিন্তু সেখানে প্রাথমিক স্কুলের গা ঘেঁষে রয়েছে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র। কোনও কোনও গ্রামে প্রাথমিক স্কুলের ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটা নয়, দু’দুটো শিশু শিক্ষা কেন্দ্র! শিশু শিক্ষা মিশনে রাজ্য স্তরের এক জন আধিকারিক স্বীকার করছিলেন, অনেক জায়গাতেই শিশু শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে কিছু মানুষের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। দশ-বারো কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক স্কুল থাকলে সে কথা গোপন করে আবেদনপত্র জমা পড়ে, ‘সচরাচর অনুমোদন দেওয়ার আগে আমাদের পক্ষে সেটি চাক্ষুষ ভাবে দেখা সম্ভব হয় না।’
এই পরিস্থিতিতে বহু প্রাইমারি স্কুলেই ছাত্র ঘাটতি রীতিমত প্রবল। তার ফলে মিড-ডে মিল চালানোর টাকা নিয়েও খুব টানাটানি চলে। একটা স্কুলে যদি মোট ছাত্রছাত্রী সংখ্যা পঞ্চাশও হয় এবং উপস্থিতি পঞ্চাশ শতাংশের বেশি হয়, তবু মাথাপিছু ৩ টাকা ৩৭ পয়সা বরাদ্দে জ্বালানি খরচ বাদে ডাল ও সব্জি বা ডিম দেওয়া বাস্তবে অসম্ভব। আর যেখানে মোট উপস্থিতি সাত থেকে আট জন, সেখানে তো বিরাট সমস্যা। এ ভাবেই আখাম্বা স্কুলবাড়িতে টিমটিমে কয়েক জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে, মধ্যাহ্নভোজনের বিরতিতে খেঁচড়ি ভাত পাতে পড়ে। এ ভাবেই বেড়ে চলে আমাদের দীপঙ্করদের অপুষ্টি, বিঘ্নিত হয় আমাদের মিড-ডে মিল প্রকল্প। ছাত্র উপস্থিতির বিষয়টিতে নজর না দিলে রাজ্য জুড়ে অনেক স্কুলের বহু বাচ্চা মিড-ডে মিলের সুফল থেকে যেমন বঞ্চিত হবে, তেমনই তাদের অপুষ্টিকেও প্রতিহত করাও সম্ভব হবে না।
ছাত্র উপস্থিতির সমস্যা ছাড়াও আছে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ টাকার অনিয়মিত জোগান। কয়েক দিন আগে দেখে এলাম, মুর্শিদাবাদ ও কোচবিহার জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকের বহু স্কুলে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বকেয়া টাকা স্কুলগুলোয় পৌঁছায়নি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা সামান্য পুঁজিতে (চার-পাঁচ মাস) মিড-ডে মিল চালাতে অসুবিধায় পড়ছেন, ডালে জলের পরিমাণ বাড়ছে। কোথাও কোথাও বা প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা জ্বালানি কেনার টাকা ধার দিচ্ছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের। মুদিখানার দোকানদাররাও ধার দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ ভাবে তো সমস্যা মিটতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধারে সব্জি কেনার সুযোগ না থাকায় দু’টুকরো আলু কিংবা তিন-চার টুকরো সয়াবিনের পাতলা ঝোল শিশুর পাতে পড়ে। আমাদের শিশুরা খড়ি-ওঠা হাতে ট্যালটেলে ঝোল দিয়ে মাখা গরম ভাত পরম তৃপ্তিতে পেট ভরে খায়।
গবেষণার কাজে ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি, কিছু কিছু জেলায় অনেক বাচ্চার এটুকুও জুটছে না। কোন গোষ্ঠী রান্না করবে সেই বিবাদে দীর্ঘদিন ধরে মিড-ডে মিল বন্ধ। শিক্ষক গ্রামবাসী কোনও ভাবেই এর সমাধানসূত্র খুঁজে পাননি। গ্রামবাসী দেখেন স্কুলে রান্না বন্ধ, বস্তা বস্তা চাল পচে নষ্ট হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে চাল বিলি করার দাবিও ওঠে, বি ডি ও হুঙ্কার দেন ‘আমার চাল পচুক, নষ্ট হোক, আমি বুঝব।’ গ্রামবাসীর অনুরোধে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতির দ্বারস্থ হলে বি ডি ও-র সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস মেলে। বামফ্রন্ট আমল থেকেই মিড-ডে মিল বন্ধ থাকার সমস্যাটি চলে আসছে, সুষ্ঠু সমাধানের প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না।
এ সব দেখে মনে হয়, কী হবে অমুক কমিটি, তমুক টাস্ক ফোর্সে? জেলা স্তরে কাজ না হওয়ায় টাস্ক ফোর্সের এক কর্তার দ্বারস্থ হলে তিনি পরামর্শ দেন রাজ্য স্তরে মিড-ডে মিলের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার। তিনি দাবি করেন, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তা হলে ক’দিন আগে যা দেখে এলাম, সেগুলো? গর্জে উঠলেন, ‘ও সব ঠিক হয়ে গেছে, জানেন না তো জেনে নিন।’ স্কুলগুলোতে যোগাযোগ করে জানলাম অনিয়মিত টাকার জোগান বা বন্ধ মিড-ডে মিল ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবে সমিতি কমিটি বা টাস্ক ফোর্সের কর্তারা কী করবেন? এখানে ওখানে মিটিং ডাকবেন, সরকারি টাকায় গাড়ি চড়বেন আর দূরদূরান্তর থেকে মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের ডেকে এনে ভাষণ দেবেন?
কোন গোষ্ঠী রান্না করবে সে নিয়ে বিবাদ নতুন নয়। অনেক স্কুলেই শিক্ষক-শিক্ষিকা বা ভি ই সি নিজেরাই সমাধানের পথ খুঁজে নিয়েছেন। পালা করে দু’তিনটি গোষ্ঠী রান্না করে, যে কোনও একটি গোষ্ঠীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে, তারা হস্তান্তরিত করে অন্য গোষ্ঠীকে। এই ব্যবস্থাতেও যে কোথাও কোনও সমস্যা নেই তা নয়, কিন্তু তা মিড-ডে মিল বন্ধ করে দেয় না।
এমনও তো হতে পারত যে শিক্ষক-শিক্ষিকা, ভি ই সি, স্বনির্ভর গোষ্ঠী সকলে উদ্যোগী হয়ে যাঁরা রান্না করবেন, তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সহ গোষ্ঠীর নাম বি ডি ও অফিসে জমা দিতেন। প্রধান শিক্ষক প্রতি মাসে মিড-ডে মিলের হিসেব জমা দেওয়ার সময় যাঁরা রান্না করেছেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-সহ সেই গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করে দিলে অন্য গোষ্ঠীকে টাকা হস্তান্তরিত করার সমস্যাটুকুও আর থাকত না। টাস্ক ফোর্সের কর্তারা যদি একটু আন্তরিক হতেন, তবে এ ধরনের উদ্যোগ বা সমাধানসূত্র অন্যান্য জায়গায় প্রয়োগের কথা ভাবতেন গোষ্ঠী-কোঁদলে বন্ধ থাকা মিড-ডে মিল চালু করা সম্ভব হত। হয়তো বা অন্য আর একটি খাদ্য সুরক্ষা বিল আসার আগেই আমরা শিশুর পুষ্টি বা মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজনটিকে সুরক্ষিত করতে পারতাম।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ গবেষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.