ছাপরার স্কুলটিতে সে দিন পাঠ্যপুস্তক বিলি হওয়ার কথা ছিল। আর তাই উপস্থিতি ছিল দ্বিগুণ।
বোঝাই যাচ্ছে, কেবল খাবার জন্য নয়, শিক্ষার প্রয়োজনেও বাচ্চারা স্কুলে আসে। আসলে শিক্ষা
ও স্বাস্থ্য, এই দুটি তো কখনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার হতে পারে না। |
অন্নদাশঙ্কর রায় ‘পথে প্রবাসে’তে বার বার লিখেছিলেন পশ্চিম দুনিয়ার দেশগুলোর ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের সমস্কন্ধের মতো মেশা’র কথা: ‘কোনও ব্রাহ্মণের কাছে নতশির থাকতে হয় না, কোনও মনিবের কাছে মাটিতে মিশিয়ে যেতে হয় না।’ নানা জাতের লোক সেখানে একসঙ্গে খাবার টেবিলে যে ভাবে সমবেত হয়, তা দেখে তিনি লিখছেন, ‘সভাসমিতিতে সব দেশের লোক ততটা অন্তরঙ্গ ভাবে মিশতে পারে না, যতটা মেশে খাবার টেবিলে। এই সত্যটা জানা থাকলে আমরা হিন্দু-মুসলমানে জনসভা না ক’রে জন-ভোজ করতুম এবং ব্রাহ্মণের ডান দিকে মুসলমানকে ও বাঁ দিকে নমঃশূদ্রকে আসন দিয়ে দুটো মহাসমস্যার মীমাংসা দুটো দিনেই করতুম।’
নানা সম্প্রদায় ও শ্রেণির ছাত্ররা স্কুলে একসঙ্গে বসে সাদামাটা অথচ স্বাস্থ্যকর রান্না করা খাবার খেয়ে পুষ্টির প্রয়োজন মেটানোর সঙ্গে জন-ভোগের মধ্য দিয়ে কাছে আসবে, সামাজিক ভেদাভেদের প্রথাসিদ্ধ ব্যাকরণ ভুলবে, এটাই ছিল আশা। সে প্রত্যাশা যে পুরোটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। তবে যখন থেকে সমাজের প্রান্তবাসী ছেলেমেয়েরা ক্রমে সরকারি স্কুলে প্রবেশাধিকার পেল, তখন থেকে সরকারি স্কুলগুলোই ব্রাত্য হয়ে পড়ল বেসরকারি স্কুলমুখী উচ্চবর্গের মানুষের কাছে, হয়ে দাঁড়াল ‘দলিত স্কুল’।
বিহারের প্রান্তিক এলাকায় একটি ভগ্নস্বাস্থ্য সরকারি স্কুলে ২৩ জন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুকে অপ্রতিরোধ্য দুর্ঘটনা বলা যাবে না, কারণ এখানে অনুঘটক হল সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের সুখদুঃখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সমাজের ক্ষমতাবান ও বিত্তবানদের উদাসীনতা।
যে গ্রামটিতে এই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, সেটির আর্থ-সামাজিক ছবি অনেক রূঢ় সামাজিক সত্যকে তুলে ধরে। জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ তফসিলি গোষ্ঠীর (রাজ্যের গড়ের থেকে বেশি), ২০০১-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী মেয়েদের সাক্ষরতার হার ১৯ শতাংশ। খেতমজুরি করে বেঁচে থাকেন প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ। শিক্ষা, কাজ ও সামাজিক স্তর বিন্যাসের নিরিখে গোটা গ্রামটিই যেন প্রান্তবাসী। |
গ্রামের স্কুলটিরও তাই ভগ্নদশা। রাজ্য উপদেষ্টা দলের পরিদর্শনের পর তাদের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এটি জানলাবিহীন ২০০ বর্গফুটের এক কামরার স্কুল, পাশে ১০০ বর্গফুটের বারান্দা, ঘর ও বারান্দার মেঝে অপরিচ্ছন্ন, স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গিয়েছে। দু’জন শিক্ষকের এক জন সন্তানসম্ভবা, ছুটিতে। বিদ্যালয়ে রান্না করার, রান্নার সামগ্রী রাখার ঠিকঠাক বন্দোবস্ত নেই, দূষণের ভয়ে স্কুলের পাশের চাপকলের জল শিক্ষকেরা খান না।
একই রিপোর্ট অনুযায়ী মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দ টাকার কেবল ৬০ শতাংশ খরচ হয় রাজ্যে এবং রান্নাঘর তৈরির জন্য প্রাপ্ত টাকার মাত্র ৫০ শতাংশ। অভাব ও অ(প)ব্যবহারের এই দুঃসহ সহাবস্থানকে এতটা সহনীয় করে তোলা যায় ক্ষমতার কোন কৌশলে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোন ঘাটতিতে আর সামাজিক ঔদাসীন্যের কোন রসায়নে, তা অবিলম্বে ভাবা দরকার। কারণ, এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে অনেক না-জানতে চাওয়া বা না-দেখতে চাওয়া তথ্য অস্বস্তিকর ভাবে চোখের সামনে হাজির হতে পারে। আশা করা যায়, সেই তাড়নায় সমাজের কিছু অংশের মধ্যে অন্তত তৈরি হতে পারে এক অধৈর্য যা অসহনীয়, তা সহ্য করে যাওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে এক গঠনমূলক গণ-আলোচনা ও প্রয়াস।
কী করণীয়, তা ভাবতে বসে অবশ্য আমাদের দৃষ্টি শুধু স্কুল চত্বরের মধ্যে, মিড-ডে মিলের বন্দোবস্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। বিদ্যালয় একটি বৃহত্তর ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রোথিত। বাজার অর্থনীতির দোলাচল, স্বাস্থ্য, যানবাহন পরিষেবার হালহকিকত, খাবার তেল ইত্যাদিতে ভেজাল প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা সব কিছুরই প্রভাব পড়ে বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের ওপর। খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে তাদের অভিভাবকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছতে। কিন্তু, পরিদর্শক দলের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঠিকঠাক যানবাহনের অভাবে কারও কারও হাসপাতালে পৌঁছতে বা পৌঁছেও উপযুক্ত পরিষেবা পেতে সময় লেগেছে চার ঘণ্টার বেশি। এই চূড়ান্ত শ্লথতার মোকাবিলা করার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকেও নজর দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
আগে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা কীটনাশক, রাসায়নিকের বিপজ্জনক পরিণাম সম্বন্ধে খানিকটা সতর্কতা জারি রাখতেন। এখন অবশ্য বেসরকারি ‘ডিলার’দের প্রতিপত্তি। গ্রামাঞ্চল বা শহরতলির কোনও কোনও এলাকায় মুদির দোকানে খাবার তেল থেকে কেরোসিন, কীটনাশক সবই বিক্রি হয়। কোন শিশিতে কোন তেল ঢালা হল, তার উপর কঠোর নজরদারি রাখছে কে, বিশেষত যখন উপভোক্তারা হলেন নিম্নবর্গের মানুষজন?
উনিশশো সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ও জেলা স্তরের সরকারি স্কুলগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত পুষ্টিকর স্বাদু রান্না করা খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা হত। তখন অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছাত্ররা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তাদের সামাজিক ব্যবধান বিশেষ ছিল না। এখন সরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক শ্রেণি এবং নতুন প্রজন্মের ছাত্রদল ‘সমস্কন্ধের’ মানুষ নন। অতএব ঔদাসীন্য।
সমাধানের সূত্র হিসেবে কেউ যদি প্রস্তাব দেন যে, স্কুলে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা তুলে দেওয়াই ভাল ‘এ যেন উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করছে বেশি’, তা হলে অন্তত দুটো মারাত্মক ভুল হবে। এক, বহু কাল ধরে সমাজে যে ব্যবধান ও বিভাজন চলে আসছে, তাকে মুছে ফেলতে হলে সব স্তরের শিশুদের শিক্ষা ও পুষ্টির অধিকার সুনিশ্চিত করার কোনও বিকল্প নেই। আর সেই জন্যই প্রয়োজন হল পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর স্কুল-মিলের ব্যবস্থা। সে কাজে ঘাটতি থাকলে কঠোর হাতে গুণমান নিয়ন্ত্রণ করা আর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা জরুরি।
দুই, এই বৈষম্যের ও অবহেলার দেশেও নানা গবেষণায় বার বার উঠে আসছে মিড-ডে মিলের নানা উপকারী প্রভাবের কথা, যেমন শিশুদের ক্যালরি, আয়রন ও প্রোটিনের অভাব পূরণ, নিয়মিত স্কুলে আসা ও মনোনিবেশ। দেশের সব জায়গায় ছবিটা হয়তো এক রকম নয়। তাই কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে, কী ভাবে এর ব্যবস্থাপনা ও গুণগত মান উন্নত ও ন্যায্য করতে পারা গেছে ও যায় আমাদের আলোচনা ও উদ্যমকে তার সন্ধানে চালনা করা দরকার।
ফিরে আসি সেই মর্মান্তিক দিনের কথায়। পরিদর্শক দলের রিপোর্টে প্রকাশ, সে দিন অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি ছাত্র স্কুলটিতে এসেছিল, কারণ সে দিন পাঠ্যপুস্তক বিলি হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ, স্কুলের পড়াশোনায় ছাত্রদের আগ্রহ ও উৎসাহের কোনও অভাব ছিল না। সাধারণ ঘরের শিশুরা, তাদের স্বল্প-সম্বল অভিভাবকরা তাঁদের চিন্তায়, কাজে ও সিদ্ধান্তে নানা ভাবে শিক্ষার তাৎপর্য ও মর্যাদা এবং মিড-ডে মিলের উপযোগিতা সম্বন্ধে তাঁদের ইতিবাচক মতামতের সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, গবেষণার কাজে গ্রামে গিয়ে এক অভিভাবকের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কেন তাঁর মেয়েকে স্কুলে পাঠান। সেই অভিভাবক জবাব দেন, ‘ওই যে দেখছেন তাকের উপরে কীটনাশকের শিশিটা তোলা আছে, আমার মেয়ে যাতে ওটা পড়ে তার বিষময় ফল সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে, সে জন্য।’ খাবার তেলের শিশিতে যাতে প্রাণঘাতী অন্য কিছু ঢুকে না পড়তে পারে, সচেতন সুশিক্ষিত খুদে নাগরিকরা যাতে সেটা নিশ্চিত করার স্ব-ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তারই জন্য শিক্ষার ও পুষ্টির অধিকার নিয়ে আলোচনা জারি রাখা যাক।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এর অধিকর্তা |