|
|
|
|
গোলাপের পাপড়ি ছুড়লেন চন্দ্রশেখর |
শঙ্খদীপ দাস • হায়দরাবাদ |
সাড়ে তিন বছর আগেও এসেছিল এমন একটি মুহূর্ত। তখন মধ্যরাত! এমনিতেই শীর্ণ এই শরীরটা এগারো দিনের অনশন শয্যায়। কব্জিতে স্যালাইনের সুঁচ। পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হতে ওই অবস্থাতেও উঠে বসেছিলেন! গলায় গ্লুকোজের জল ঢেলে জয়ের অভিব্যক্তিও জানিয়েছিলেন দু’আঙুল ফাঁক করে। মুখে চওড়া হাসি!
সেই কলভাকুন্তল চন্দ্রশেখর রাওয়ের মুখ আজ কিন্তু গম্ভীর। যে কোনও মুহূর্তে আলাদা তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরি নিয়ে ঘোষণা হতে পারে দিল্লিতে। এত দিনের লড়াই শেষে তখন সামান্য কিছু ক্ষণের অপেক্ষা। তবু চন্দ্রশেখর রাওয়ের মুখে জমে দুনিয়ার উৎকণ্ঠা। পরনে সাদা মাড় দেওয়া জামাটায় একটু বেশি নীল পড়ে যাওয়ায় যেমন অনুজ্জ্বল, কতকটা তেমনই। তা হলে কি না-আঁচানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই!
“নেই-ই তো! যত ক্ষণ না সংসদে পৃথক রাজ্য গঠনের বিল পাশ হচ্ছে, আমার ‘যশন’ (উৎসব) করব না। বিশ্বাসের ঘাটতি তো একটা আছেই,” রুমালের খুঁট দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জানালেন চন্দ্রশেখর পুত্র কে টি রাম রাও। বানজারা হিলের ১০ নম্বর রোডে প্রাসাদের মতো এই সাদা বাড়িটার বাইরে ভোর থেকে গাড়ির লাইন। হ্যাঁ, এটাই তেলেঙ্গানা ভবন। প্রায় ষাট বছরের পুরনো পৃথক তেলেঙ্গানা আন্দোলনের নবজন্ম দিয়েছেন যে চন্দ্রশেখর, তাঁর আখড়া। বাইরে হাজার মানুষের ভিড়। তাঁদের খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। উদ্বেগের মুখ নিয়ে পায়চারি করছেন। আর সময় গুনে চলেছেন। দিনটা আজ বড়ই লম্বা! |
|
তেলেঙ্গানা ঘোষণার পর টিআরএস নেতা চন্দ্রশেখর রাও। ছবি: এএফপি |
অবশেষে সেই মুহূর্ত। ঘড়িতে সাতটা পনেরো। দিল্লিতে কংগ্রেস সদর দফতর থেকে সরাসরি সম্প্রচার টিভির পর্দায় ভেসে উঠল। ঘোষণা হল “তেলেঙ্গানার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবিকে মর্যাদা দিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনে সায় দিচ্ছে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। হায়দরাবাদই হবে তার রাজধানী।”
শুধু এই ঘোষণাই নয়, জানানো হল তেলেঙ্গানাকে আলাদা রাজ্য করে তোলার রূপরেখাও। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল তেলেঙ্গানা ভবনের ছবি। উচ্ছ্বাসের হাওয়ায় কোথায় হারিয়ে গেল একটু আগে বলা চন্দ্রশেখর-পুত্রের সংযমের কথা! ততক্ষণে ‘জয় তেলেঙ্গানা’ স্লোগান উঠেছে হাজার গলায়। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছেন। চুমু এঁকে দিচ্ছেন কপালে। কেউ আনন্দে গড়িয়ে পড়ছেন মাটিতে। নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারলেন না চন্দ্রশেখরও। ঘরের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ভিড় ঠেলে ভবনের উঠোনে এসে দু’মুঠোয় ভরে নিলেন গোলাপের পাপড়ি। তার পর প্রবল এক আগ্রাসনে ছুড়ে দিলেন দলের গোলাপি পতাকার দিকে। পরে জানালেন, কংগ্রেস যদি দ্রুত সংসদে এই সংক্রান্ত বিলটি এনে পাশ করায়, তা হলে তাঁরা তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
চন্দ্রশেখরের পিছনে ছেলে রাম রাও। ইশারা করতেই এগিয়ে এসে বললেন, “চিয়ারস্ বস্!” এ বার তা হলে বিশ্বাস হচ্ছে তো? হেসে জবাব দিলেন, “তা হচ্ছে বইকি।”
হবে না-ই বা কেন? সে দিন (২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর) কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠক থেকে বেরিয়েতৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম জানিয়েছিলেন, “পৃথক তেলেঙ্গানা গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কাল থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে।” পর দিন সকাল হতেই বাকি অন্ধ্রে বিক্ষোভের মুখে পড়ে পিছু হটেছিল কেন্দ্র। সে দিনের সঙ্গে আজকের ঘোষণার ফারাকটা কিন্তু স্পষ্ট। সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিয়ে জানানো হয়েছে, দশটি জেলা নিয়ে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন হবে। সেই সঙ্গে হায়দরাবাদকে ভবিষ্যতে পাকাপাকি রাজধানী করার অঙ্গীকারও রয়েছে।
শুধু চন্দ্রশেখর বা তাঁর পুত্র নন, চাপা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিল গোটা তেলেঙ্গানাই। বাদ ছিল না ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও, যাকে এই আন্দোলনের অন্যতম আঁতুড়ঘর বলেই এ দিন উল্লেখ করেছেন অনেকে। ছাত্রছাত্রীরাও ঘোষণা না শুনে উচ্ছ্বাস দেখাতে চাননি। বরং চোয়াল শক্ত করে জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির নেতা মাররি অনিল বলেছিলেন, “এ বারও না হলে ঠ্যালা বুঝবে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্মদা, কাবেরী, গোদাবরী হস্টেলে ভরদুপুরে ঢুঁ মেরে দেখেছি, বাইরে থেকে সকলে নিস্তরঙ্গ। কিন্তু সন্ধ্যার ঘোষণা হতেই উল্লাসে কেঁপে উঠেছে আন্দোলনের এই উৎসস্থল। ঢোল, দামামা নিয়ে পথে নেমে পড়েছেন দামাল ছেলারা। পিল পিল করে কোথা থেকে যে কয়েক হাজার ছাত্র জুটে গিয়েছেন, ঠাওর করা যায়নি। বিজয়োৎসবের খবর আসতে শুরু করেছে মহবুবনগর, করিমনগর, আদিলাবাদের মতো তেলেঙ্গানার অন্য জেলাগুলি থেকেও। ও দিকে অন্ধ্র হাইকোর্টের সামনে হুটোপাটি শুরু করে দেন আইনজীবীরা। সচিবালয়ের কর্মীদের মধ্যে যাঁরা তেলেঙ্গানার বাসিন্দা, মিষ্টি বিতরণে নেমে পড়েন তাঁরা। আকাশে ছিটকে ওঠা আতসবাজির আলোও নজর এড়ায় না। |
|
নতুন রাজ্য |
তবে এ সবই কিন্তু নিজামের শহরের কিছু ছবির কোলাজ। বাকি হায়দরাবাদের বাসিন্দারা কী বলছেন?
চারমিনারের সামনে উৎসাহ দেখা যায়নি। বাস স্টপেও নয়। বানজারা বা জুবিলি হিলের বাকি অংশেও একই ছবি। এমনকী, হুসেন সাগর হ্রদ চত্বরেও না। উল্টে যা দেখা গিয়েছে তা হল, চারমিনারের আশপাশে খাবারের দোকানে রোজা ভাঙার ভিড়। রমজানের সন্ধ্যায় হালিম বিকোচ্ছে খুব। লকড়ি কা পুলের সামনে এখন ফিস হালিমও পাওয়া যাচ্ছে। স্বভাবতই ভিড় সেখানেও। সেই ভিড় ঠেলে অন্ধ্র ভাগের প্রশ্ন ছুড়ে দিলে কখনও বিরক্তি। কখনও মুখ ভাবলেশহীন। কখনও বা ‘কী দরকার ছিল’ গোছের পাল্টা প্রশ্নও ফিরে আসছে।
তা হলে কি অন্ধ্র ভাগের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে নিজাম শহরের সকলে খুশি নন?
এর জবাব পেতে একটু পিছনে যেতে হবে। ১৯৫৬ সালে যখন রাজ্য পুনর্গঠন হয়েছিল, তখনই অন্ধ্রে সামিল হতে চায়নি তেলেঙ্গানা। কিন্তু সেই আপত্তি শোনা হয়নি।
উপরন্তু রায়লসীমা ও উপকূলবর্তী এলাকার মানুষ রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিল তেলেঙ্গানার উপরে। বস্তুত, হায়দরাবাদে ব্যবসা করেই এঁদের রমরমা এবং তার জোরেই এঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেন।
এঁদের আপত্তি তাই একটাই কারণে, তেলেঙ্গানা আলাদা রাজ্য হলে ব্যবসায় টান পড়বে। শিথিল হবে রাজনৈতিক ক্ষমতাও। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা এস রামালু বলছিলেন, “গায়ে জ্বালা ধরার আরও কারণ আছে। এত দিন তো শুধু রাজনীতিই নয়, সরকারি চাকরিতেও ওরা ক্ষমতা ভোগ করেছে। আসলে এত দিন তেলেঙ্গানার মানুষ অন্ধ্রে থেকেছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে।”
সাড়ে তিন বছর আগে মাঝরাতে ঘোষণার ১২ ঘণ্টার মধ্যে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায় দিল্লি। রায়লসীমা এবং উপকূল অন্ধ্র জুড়ে যে গোলমাল শুরু হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে স্থগিত করে দেওয়া হয় তেলেঙ্গানা গড়ার কাজ। এ বারে তাই অন্ধ্রের এই দুই অংশে অনেক বেশি বাহিনী নামানো হয়েছে। আরও হাজার জওয়ান চেয়ে পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রের কাছে। দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্ব একটি বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছেন দলের স্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদের কাছে। তা হল, সাবধান, কোনও গোলমাল যেন না হয়! ফলে রাত পর্যন্ত গুন্টুরের সাংসদ সম্ভাশিব রাওয়ের ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছে ছাড়া বাকি সব শান্ত।
তবে এই শান্তি ঝড়ের আগেকার থমথমে ভাব কি না, তা জানে না কেউই। সেটা বোঝা যাবে সকাল হলে। তাই চাপা আশঙ্কা বুকে নিয়েই আজ ঘুমোতে গেল তেলেঙ্গানা।
|
• দেশের ২৯তম রাজ্য তেলেঙ্গানা
• অন্য রাজ্যটির নাম সম্ভবত অন্ধ্রপ্রদেশই থাকবে
• তার আওতায় রায়লসীমা ও উপকূলবর্তী এলাকা
• আগামী ১০ বছর দু’রাজ্যেরই রাজধানী হায়দরাবাদ
• তার পর অন্ধ্রের নতুন রাজধানী হবে
• তেলেঙ্গানায় ১৭টি লোকসভা,
• ১১৯টি বিধানসভা আসন
• রাজ্য গঠন হতে আরও মাস ছয়েক |
|
|
পুরনো খবর: তেলেঙ্গানা আজ দিল্লির অপেক্ষায় |
|
|
|
|
|