ঘরের উঠোনেও পালাবদল
ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতেই টিকে বামেদের আশা
প্রত্যাশিতই ছিল। শুধু মাত্রাটা জানা ছিল না।
সাড়ে তিন দশক পরে প্রথম বার বর্ধমান জেলা পরিষদ হাতছাড়া হল বামেদের। তা যে হবে, পরিবর্তনের বিধানসভা নির্বাচনেই তার যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল। প্রশ্ন ছিল, রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত সিপিএম এই অঙ্কটা খানিক শুধরোতে পারে না কি আরও তলিয়ে যায়? অষ্টম পঞ্চায়েত নির্বাচনের শেষে উত্তরটা পরিষ্কার। যত সময় যাচ্ছে, জমি হারাচ্ছে বামেরা। গ্রামীণ এলাকা আগেই তাদের হাতছাড়া হয়েছিল। এ বার খনি এলাকার শেষ দুর্গও ধসে গিয়েছে।
বিপর্যয়ের পরে সিপিএম নেতাদের এখন এক মাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটে সন্ত্রাস আর কারচুপির অভিযোগ। কিন্তু জনমতের গতিপথ পাল্টাতে পারে, এমন কোনও অর্থবহ আন্দোলন গত দু’বছরে জেলা বামফ্রন্ট গড়ে তুলতে পারেনি। বেশির ভাগ জায়গায় টিকিয়ে রাখতে পারেনি সংগঠন। দলের বহু নেতা-কর্মী দল বদলেছেন, কার্যত বসে গিয়েছেন তারও বেশি। এ বারের ভোটে তাঁদের একটা আশা ছিল কংগ্রেসের ভোট কাটা (যে সুবিধা এর আগে তাঁরা দীর্ঘদিন পেয়ে এসেছেন)। তারই সৌজন্যে কাটোয়া-কালনায় মতো কিছু জায়গায় তাদের কিছুটা মুখরক্ষা হয়েছে। বাকি আশা টিকে রয়েছে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকা পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি নিয়ে। যদিও সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদার দাবি করছেন, “যেন তেন প্রকারে কোনও সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করাটা আমাদের নীতি নয়।”
কত জায়গায় এমন ত্রিশঙ্কু দশা?
হিসেব বলছে, অন্তত ২৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ৪টি পঞ্চায়েত সমিতিতে। এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিপিএম বা তৃণমূল যে কোনও পক্ষই বোর্ড গড়তে পারে। তবে তৃণমূলের পাল্লাই ভারী। কেননা সিপিএমের পক্ষে বিজেপি বা তৃণমূলের বিক্ষুব্ধদের সমর্থন চাওয়া যেমন শক্ত, তেমনই শক্ত প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সমর্থন পাওয়া।
বর্ধমানের ৩১টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে মাত্র দু’টি কাটোয়া ১ দখল করতে পেরেছে সিপিএম। ২৫টিতে জয়ী তৃণমূল। মেমারি ২ ব্লকে এখনও গণনা হয়নি। বাকি কাটোয়া ২, কেতুগ্রাম ২, পূর্বস্থলী ২ ও সালানপুর পঞ্চায়েত সমিতি ত্রিশঙ্কু। কাটোয়া ২ পঞ্চায়েত সমিতির ২১টি আসনে ভোটের ফলপ্রকাশের পরে দেখা গিয়েছে, কংগ্রেস ৫টি, সিপিএম ১০টি ও তৃণমূল ৬টি আসন পেয়েছে। যদি অতীতের লোকসভা ভোটের আগের মত কংগ্রেস-তৃণমূল ফের ক্ষমতা দখলের জন্য জোট করে ফেলে, তা হলে ওই সমিতি তাদেরই। কেতুগ্রাম-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপি ১, সিপিএম ৯, আরএসপি ১ ও তৃণমূল ৯টি আসন পেয়েছে। এখানে বামফ্রন্টের হিসেবে ক্ষমতা দখলের কথা, কিন্তু তা ঠেকাতে বিজেপির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারে তৃণমূল, এমন সম্ভবনা স্থানীয় নেতারাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
পূর্বস্থলী বরাবরই তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। এই এলাকায় দু’টি ব্লকে একদা বিজেপির সঙ্গে জোট করে সিপিএমকে বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে হটিয়েছিল তৃণমূল। এ বার পূর্বস্থলী-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে ২৭টি আসনের মধ্যে বিজেপি ২, সিপিএম ১৩ ও তৃণমূল ১২টি আসন পেয়েছে। এই সমিতিতে সিপিএমকে বোর্ড তৈরি করতে না দিতে হলে বিজেপি-র সঙ্গে আঁতাঁত করতেই হবে তৃণমূলকে। সালানপুর সমিতির ২৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪, সিপিএম ১০, ফরওয়ার্ড ব্লক ১ ও তৃণমূল ৮টি আসন পেয়েছে। সেখানে ক্ষমতাল দখল করতেও তাদের কংগ্রেসকে সঙ্গে চাই।
গলসি-১ ব্লকের উচ্চগ্রামে সিপিএম ও সিপিআই মিলে পেয়েছে ১৬ আসনের মধ্যে সাতটি। এখানে তৃণমূলের জেতা আসনের সংখ্যা ৮। নির্দল ১। এই নির্দলকে সঙ্গে নিতে পারলে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে তৃণমূল এখানে নিশ্চিন্ত হতে পারে। আউশগ্রাম-২ ব্লকের অমরপুরে মোট আসন ১৫টি। সিপিএম ৬, তৃণমূল ৪ ও কংগ্রেস ৩টি আসন পেয়েছে। গলসি-২ ব্লকের কুরকুবাতে সিপিএম ৬, তৃণমূল ৪ ও নির্দলেরা ৩টি আসন পেয়েছে। এখানে ক্ষমতায় আসতে গেলে বিক্ষুব্ধদের সমর্থন দরকার শাসকদলের। খণ্ডঘোষের লোদনায় অনায়াসেই বোর্ড গড়তে পারেন নির্দলেরা। ১৪ আসনের এই পঞ্চায়েতে তাঁরা ৬টি আসনে জিতেছেন। তৃণমূল ৫ এবং সিপিএম, আরএসপি ও কংগ্রেস এখানে জিতেছে একটি করে আসন। শাঁকারি-২য়েও ৯টি আসনের মধ্যে সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, বিজেপি ও কংগ্রেস জিতেছে ১টি করে আসন। তৃণমূল জিতেছে ৪টিতে। ফলে এই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখলের জন্য কংগ্রেস বা বিজেপির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে তৃণমূলকে। কালনা-১ ব্লকের বাঘনাপাড়ায় ১৬ আসনের মধ্যে সিপিএম ৭, তৃণমূল ৮ ও কংগ্রেস ১টি আসনে জিতেছে। এই ব্লকের বাদলায় ১৬ আসনের মধ্যে সিপিএম ও তৃণমূলের জেতা আসনের সংখ্যা ৮টি করে। অকালপৌষে দুই দল জিতেছে ৬টি করে আসন, ৩ আসন পেয়েছেন নির্দলেরা। সাতগেছিয়ায় তৃণমূল জিতেছে ২০-র মধ্যে ১০টি আসন। কিন্তু সিপিএম ৯ ও কংগ্রেস ১টি আসনে জেতায় এই পঞ্চায়েত আসলে ত্রিশঙ্কু। পূর্বস্থলী-১ ব্লকের নসরতপুরে ৩০ আসনের মধ্যে আবার বিজেপি ও তৃণমূল ১২টি করে পেলেও, সিপিএম পেয়েছে ৬ আসন।
মন্তেশ্বর ব্লকের দেন্দুয়াতে ১০টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৫, তৃণমূল ৩ ও নির্দলেরা ২টি আসনে জিতেছে। এখানে সিপিএমকে আটকাতে তাই নির্দলদের সমর্থন দরকার তৃণমূলের। স্থানীয় বামুনপাড়ায় মোট আসনের সংখ্যা ১২। তার মধ্যে সিপিএম ও তৃণমূলের প্রাপ্তি অর্ধেক করে। মন্তেশ্বরের পুঁটশুড়িতে ১২ আসনের মধ্যে সিপিএম ৪, তৃণমূল ৫ ও নির্দলেরা পেয়েছে ২টি। এই নির্দলদের সমর্থন পেলেই তৃণমূল ক্ষমতায় থাকতে পারে। মামুদপুর-২য়েও অবস্থা একই। কাটোয়া-১ ব্লকের সরগ্রামে ১১টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৪ ও ফরওয়ার্ড ব্লক ১টি আসন পেয়েছে। তৃণমূল পেয়েছে ৫টি আসন। কিন্তু বোর্ড গড়তে তাদের দরকার একটি আসনে জেতা নির্দল প্রার্থীকে। মঙ্গলকোটের নিগনে সিপিএম জিতেছে ৭টি আসনে। তৃণমূলের জয় সাতটিতে। ফলে বিজেপির জয়ী ২ সদস্যের ভোট না পেলে প্রধান পদে তাঁদের সদস্যকে জেতাতে পারবে না তৃণমূল। কেতুগ্রাম ২ ব্লকের কেতুগ্রাম গ্রামপঞ্চায়েতে ১১ আসনের মধ্যে কংগ্রেস, বিজেপি ও সিপিএম জিতেছে তিনটি করে আসন। দু’টিতে জিতেছে তৃণমূল। গঙ্গাটিকুরিতে ১৪ আসনের মধ্যে সাতটিতে জিতেছে সিপিএম। কিন্তু তাদের বোর্ডকে সর্বদাই সমস্যায় ফেলতে ৬ আসন পাওয়া তৃণমূলের দরকার কংগ্রেসের এক মাত্র জয়ী সদস্যকে।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি আজিজুল হক মণ্ডলের কথায়, “আমরা তৃণমূলকে সমর্থন করব কি না, প্রদেশ কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেবে।” জেলা বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ নন্দীও বলেন, “রাজ্য নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন।” সিপিএমের অমলবাবুর দাবি, “নীতি বিসর্জন দিয়ে আমরা কারও সমর্থন নিতে পারব না। তাতে যদি সব জায়গাতেই আমাদের পরাস্ত হতে হয় তো হবে।” এক পা এগিয়ে তৃণমূলের অন্যতম জেলা পর্যবেক্ষক অলোক দাস, “আমরা কাউকে আগ বাড়িয়ে সমর্থন করতে বলব না। তবে আশা করব, বিজেপি বা কংগ্রেসের জয়ী সদস্যেরা তৃণমূলে যোগ দেবেন। তা হলে তাঁদের নিয়ে আমরা আরও বেশি কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখল করতে পারব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.