একটুর জন্য ম্যাজিক সংখ্যা ফস্কে গিয়েছে সিপিএমের।
২৩ আসনের সালানপুর পঞ্চায়েত সমিতি দখল করতে গেলে দরকার ছিল পাক্কা এক ডজন আসন। কিন্তু বামফ্রন্ট থেমে গিয়েছে এগারোয়। আটটি আসন দখল করেছে তৃণমূল। কংগ্রেস পেয়েছে সাকুল্যে চারটি। তবু সম্ভবত সেই কংগ্রেসের হাতেই থাকছে ক্ষমতার আসল ‘চাবিকাঠি’।
ত্রিমুখী-চতুর্মুখী লড়াইয়ের এই বাজারে গোটা রাজ্যেই কিছু কিছু এলাকায় এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে জোটের প্রকাশ্য সমীকরণ কী হবে, তা ঠিক করবেন বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্ব। কিন্তু ব্লক স্তরের নেতারা জানেন, স্থানীয় ভাবাবেগকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। তাই নিচুস্তরে যে ইতিমধ্যেই কথা চালাচালি শুরু হয়ে গিয়েছে তা কোথাও আকারে ইঙ্গিতে, আবার কোথাও প্রকাশ্যেই নেতারা বলছেন।
২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে সালানপুরে বামফ্রন্টকে একেবারে দুরমুশ করে দিয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। এ বারের ভোটে কিছুটা হলেও সেই হারানো জমি ফিরে পেয়েছে সিপিএম। জেলা জুড়ে যেখানে তৃণমূলের প্রবল দাপট, সেখানে প্রায় হাতের মুঠোয় এসে যাওয়া সালানপুর পঞ্চায়েত সমিতির দখল সহজে ছাড়তে চাইছে না তারা। এই অবস্থায় খানিকটা আপস করে যদি কংগ্রেসকে পাশে পাওয়া যায়, তাতে ক্ষতির কিছু দেখছেন না ব্লকের সিপিএম নেতৃত্ব। কংগ্রেসের ব্লক স্তরের কেউ কেউ যে ইতিমধ্যে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন, তা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন সিপিএমের জোনাল সম্পাদক অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সমিতির গঠন বা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচনে কংগ্রেসের কেউ যদি সমর্থন করেন, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তবে প্রকাশ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত বা সমিতির জোট গঠনের বিষয়ে রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।”
ব্লকের কংগ্রেস নেতারা অবশ্য বলছেন, জোট বা সমর্থনের প্রশ্নে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি যদি কোনও লক্ষ্মণরেখা টেনে দেয়, তাঁরা সেটাই মানবেন। কিন্তু তা যদি না হয়, তবে ‘মধ্যপন্থা’ অবলম্বন করতে আগ্রহী তাঁরা। ব্লকের এক প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতার ব্যাখ্যা, বাইরে থেকে বামফ্রন্টকে সমর্থন দিয়ে তাঁরা যতটা সম্ভব নিজেদের এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করিয়ে নিতে চান। সে ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট যদি বৈষম্য করে, তবে তৃণমূলকে পাল্টা সমর্থনের জুজু দেখিয়ে তাদের হাতে রাখা সহজ হবে। এ ভাবেই হেরেও নিজেদের জমি গুছিয়ে নিতে চাইছে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেসের সদস্য শ্যামল মজুমদার বলেন, “যে এলাকা থেকে আমাদের প্রার্থীরা জিতে এসেছেন, সেখানকার মানুষের স্বার্থ দেখাটা আমাদের প্রথম কাজ। তাঁদের উন্নয়নের কথা ভেবেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”
অনেক আগে থেকেই সালানপুর কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূূলের উত্থান হলেও, গত ভোটে তৃণমূলকে পাশে পেয়ে বামবিরোধী ভোট এক জায়গায় ধরে রাখতে পেরেছিল তারা। কিন্তু বারাবনি বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ে সালানপুর। এলাকার বিধায়ক তৃণমূলের। মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে বারাবনি ব্লকেও তৃণমূলের একাধিপত্য রয়েছে। সেই সুবাদে সালানপুর এলাকাতেই গত পাঁচ বছর ধরে একটু-একটু করে সাংগঠনিক জাল বিস্তার করেছে রাজ্যের শাসকদল। কংগ্রেসের একাধিক প্রভাবশালী কর্মী ও সংগঠককে ভাঙিয়ে নিজেদের দিকে আনতে পেরেছেন তৃণমূল নেতারা। এক শ্রেণির ক্ষমতাপিপাসু কংগ্রেস নেতা-কর্মীও দল বদলে এবার তৃণমূলের হয়ে ভোট লড়েছেন।
নিট ফল, কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে ভাল রকম থাবা বসাতে পেরেছে তৃণমূল। তার জেরে বামবিরোধী ভোটও ভাগ হয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই গত বার জিতে আসা সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত এ বার হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। একটি গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। একটিতে তৃণমূল আর সিপিএমের আসন সমান। দু’টি পেয়েছে বামেরা। আর বাকি তিনটিতে সিপিএম সর্বাধিক আসন পেলেও পরিস্থিতি ত্রিশঙ্কু হয়ে গিয়েছে।
তৃণমূল অবশ্য এখনই সমর্থন জোটানোর প্রশ্নে নিশ্চিত করে কিছু বলতে রাজি নয়। কেননা তাঁদের প্রায় নিশ্চিত ধারণা, প্রদেশ নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়া কংগ্রেসের চার জন তাঁদের সমর্থন করবেন না। সে ক্ষেত্রে বিরোধী আসনে বসে শাসকপক্ষকে ক্রমাগত চাপের মুখে রেখে পর্যুদস্ত করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করছেন দলের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাপ্পু উপাধ্যায়। তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি অপূর্ব মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “এখনই বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি। দল কেন্দ্রীয় ভাবে যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেই মতোই কাজ হবে।”
অঙ্কটা যে খুব সহজে মিলবে না, তা বলাই বাহুল্য। |