দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির দু’টিই গিয়েছে। ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি ছিল তৃণমূলের দখলে। এ বার আরও ১০টি হাতছাড়া হয়েছে। জেলা পরিষদের চারটি আসনও দখল করে নিয়েছে তৃণমূল। সিপিএমের বরাবরের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত দুর্গাপুর শহর লাগোয়া দুই ব্লক কাঁকসা ও দুর্গাপুর-ফরিদপুরে কার্যত অস্তিত্ত্বের সঙ্কট বামফ্রন্টের।
কাঁকসা ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা সাত। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সবগুলিই বড় ব্যবধানে দখল করেছিল বামফ্রন্ট। এ বার কাঁকসা ও ত্রিলোকচন্দ্রপুর বাদে বাকি ৫টি হারাতে হয়েছে। তার মধ্যে বিদবিহারে বামফ্রন্টের কোনও প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেখানে আগেই জিতে গিয়েছিল তৃণমূল। আমলাজোড়াতেও ২১টি আসনের মধ্যে একটি পেয়েছে বামেরা। গোপালপুরে ২৫টি আসনের মধ্যে বামেরা পেয়েছে মাত্র ৩টি। তুলনায় ভাল ফল বনকাটি ও মলানদিঘিতে। বনকাটিতে আর একটি আসন পেলেই বোর্ড গড়তে পারত তারা। ফল ৬-৭। মলানদিঘিতে ১৮টির মধ্যে ৭টি আসন গিয়েছে বামেদের দখলে।
গত বার কাঁকসায় পঞ্চায়েত সমিতির সব আসনই ছিল বামফ্রন্টের দখলে। এ বার তারা ২১টি আসনের মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৫টি। কাঁকসা অঞ্চলে দু’টি আসনে বাম প্রার্থীরা জয় পেলেও ২০ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির আসনটিতে সিপিএমের প্রাক্তন কাঁকসা জোনাল সম্পাদক তথা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বীরেশ্বর মণ্ডলের স্ত্রী বন্দনা মণ্ডল হেরে গিয়েছেন। ওই আসনে জিতেছেন তৃণমূল যুব সভাপতি পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলা পরিষদের একটি আসনে অবশ্য এর থেকেও বড় ধাক্কার মুখোমুখি হতে হয়েছে দলের বর্তমান জোনাল সম্পাদক তথা জেলা পরিষদের দুই দশকের কর্মাধ্যক্ষ অলোক ভট্টাচার্যকে। তিনি ১৩০৬০ ভোটে হেরেছেন তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি দেবদাস বক্সীর কাছে। অথচ জেলা পরিষদের এই ৫৬ নম্বর আসনটিতে গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় ছ’হাজার চারশো ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। সেই হিসেবে প্রায় ২০ হাজার ভোট টেনেছেন দেবদাসবাবু। জেলা পরিষদের ৫৭ নম্বর আসনে বাম প্রার্থীকে ৪৭২৪ ভোটে হারিয়েছেন তৃণমূলের ব্লক যুব সভাপতি পল্লববাবুর স্ত্রী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।
কাঁকসার থেকেও বামেদের পরিস্থিতি প্রতিকূল দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকে। আগের বার ব্লকের একটি মাত্র গ্রাম পঞ্চায়েত গিয়েছিল তৃণমূল জোটের হাতে। এ বার ব্লকের বাকি ৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতও ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। হাতছাড়া হয়েছে পঞ্চায়েত সমিতি। জেলা পরিষদের দু’টি আসনও গেল তৃণমূলের দখলে। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট হারে একমাত্র ইছাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে। প্রাপ্ত ভোটের নিরিখেও বিরোধীদের সম্মিলিত ভোটের থেকে ওই পঞ্চায়েতে ১৫৮ ভোটে পিছিয়ে ছিল বামফ্রন্ট। গৌরবাজার, গোগলা, জেমুয়া, লাউদোহা ও প্রতাপপুরে এগিয়ে ছিল তারা। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট পেরিয়ে সেই ধারা বজায় ছিল ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও। পরিবর্তনের প্রবল ঝড়ে ভেঙে পড়ে একের পর এক লাল দুর্গ। অথচ সেই ঝড় অগ্রাহ্য করে এই ব্লক থেকে সিপিএম প্রার্থী গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় ‘লিড’ পান প্রায় চার হাজার চারশো ভোটের। অথচ সেই ব্লকের ৬টি পঞ্চায়েতই এ বার দখল করে নিয়েছে তৃণমূল। এমনকি লাউদোহা পঞ্চায়েতটি তৃণমূল দখল করেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আগের বার এই ব্লকে বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত সমিতি গড়েছিল বামফ্রন্ট। এ বার ১৭টি আসনের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল জিতেছিল ৮টি। বাকি ৯টির মধ্যে একমাত্র জেমুয়া-পরানগঞ্জ এলাকার আসনে জিতেছে সিপিএম। জেলা পরিষদের দু’টি আসনও বামফ্রন্টের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল।
দুই ব্লকেই সিপিএমের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের দাবি, তৃণমূলের সন্ত্রাসের পাশাপাশি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বের সঙ্গে এলাকার মানুষের সংযোগ না থাকার কারণেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কাঁকসার এক নেতা বলেন, “বিধানসভা ভোটের মতো পরিস্থিতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে ছিল না। তৃণমূলের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে অনেকেরই। কিন্তু সিপিএমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় সাধারণ মানুষ ভরসা পাননি।” একই দাবি দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের এক নেতারও। তিনি বলেন, “দল যাঁদের এলাকায় দায়িত্বে রেখেছে তাঁরা এখনও সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেননি। দুর্গাপুর শহর থেকে দল চালানোর তত্ত্ব এ বার বদলাতে হবে। না হলে গ্রামের মানুষ আর আমাদের দিকে ফিরবেন না।” পঞ্চায়েত ভোটের আগে স্থানীয় তিন লোকাল সদস্যকে যথাযথ ভূমিকা পালন না করায় ছেঁটে ফেলে সিপিএম। সে প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ ওই নেতা বলেন, “শুধু লোকাল সদস্যকে বহিষ্কার করলেই হবে না। প্রয়োজনে বড় নেতার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।”
দলের উচ্চ নেতৃত্ব অবশ্য শুধু তৃণমূলের সন্ত্রাস নিয়েই সরব। দলের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের অভিযোগ, “আগে ভোট লুঠ হয়েছিল। গণনার সময়েও বহু আসনে ফলাফল উল্টে দেওয়া হল। নজিরবিহীন সন্ত্রাসের শিকার আমরা।” সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের পাল্টা দাবি, মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়াতেই হার সিপিএমের।
|