ভিক্ষে করিনি তো, বারে নেচেছি

এটা কি সত্যি যে আপনি নিজের বাবা-মায়ের পরিচয় জানেন না ?

একবার শুনেছিলাম আমার দিদিই নাকি আমার মা। তার পর শুনেছি আমি নাকি বাড়ির কাজের লোকের অবৈধ সন্তান। তার সম্পর্ক ছিল এক ড্রাইভারের সঙ্গে। আবার এও শুনেছি যে আমার বাবা নাকি উকিল ছিলেন। এক গরিব মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়...
শগুফতা রফিক


তা আপনার দিদি, মা এঁরা তো সবাই বলিউডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন...
আমার জন্ম এক ফিল্মি পরিবারে। মা আনওয়াড়ি বেগম পঞ্চাশের দশকে সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্র করতেন। দিদি সায়েদা খান। অশোককুমার থেকে কিশোরকুমার সবার সঙ্গে কাজ করেছিল। দিদি বিয়ে করেছিল প্রযোজক ব্রিজ শাদানাকে। উনি ‘দো ভাই’, ‘ভিক্টোরিয়া নং ২০৩’য়ের মতো ফিল্ম প্রযোজনা করেছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে উনি মদ্যপ হয়ে যান। ১৯৯০ সালের এক রাতে আমার দিদি, বোনঝি, বোনপো আর নিজেকে গুলি করেন! আমার বোনপো শুধু বেঁচে যায়। সেই বোনপো হলেন অভিনেতা কমল সদানা। কাজল অভিনীত ‘বেখুদি’-তে ছিলেন তিনি।

কমল নিজের জীবনের ওই ঘটনা নিয়ে একটা শর্ট ফিল্ম বানিয়েছিলেন। দেখেছেন সেটা?
না, আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক নেই।

যাঁকে মা বলে ডাকেন, হঠাৎ কেন সন্দেহ হল যে তিনি আপনার মা নন?
দশ বছর বয়স পর্যন্ত জানতাম মিসেস আনওয়াড়ি বেগম আমার মা। কিন্তু বুঝতাম বাড়ির অন্যান্য বাচ্চা আর আমার মধ্যে একটা ফারাক করা হচ্ছে। আমার বৌদি আমাকে একদম পছন্দ করত না। বাচ্চাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েই থাকে। কিন্তু ভাইপো, ভাইঝিদের সঙ্গে আমার ঝগড়া হলে বৌদি একেবারে রে-রে করে ছুটে আসত। দাদা প্রথম দিকে ভালবাসলেও পরে ‘জরু কা গুলাম’ হয়ে গিয়েছিল। যখন আমার এগারো, ও একটা কাণ্ড করে বসল।

অত ছোটবেলার কথা মনে আছে?
এত সঙ্ঘাতিক ঘটনা যে আমি কিছুতেই তা মন থেকে মুছতে পারিনি। শাড়ি পরেছিলাম সে দিন দুপুরে। দাদা আমাকে ডেকে বলেছিল: ‘আমি একটা কথা তোকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে চাই, তুই এই পরিবারের কেউ না।’ মানে ও আমার দাদা নয়। আমি যেন ওর ছেলেমেয়েকে সম্মান করে কথা বলি। কারণ ওরা বাড়ির মালিক আর আমি ‘বাড়ির এক কাজের লোকের অবৈধ সন্তান।’ আমি ভেবেছিলাম মা সব শুনে রেগে যাবেন। কিন্তু দেখলাম স্বাভাবিক ভাবেই কথার উত্তর দিলেন। সে দিনের পর থেকে আমি পৃথিবীর সব চেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ হয়ে গেলাম।

সায়েদা যে আপনার মা সেটা কী করে মাথায় এল?
দিনদিন আমার কমপ্লেক্স বাড়তে থাকে। স্কুলে ফেল করতে শুরু করি। একদিন মা-কে এক আত্মীয় এসে বলেন যে মেয়েটা প্রায় মরতে বসেছে, ওকে সত্যিটা বলে দাও। তার পর মা ডেকে বললেন, দাদা যা বলেছিল সেটা সত্যি। এতে আরও ভেঙে পড়লাম। দিদিও এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করত না। এই সময় চার দিকে নানা কথা শুনতাম আমার বাবা-মায়ের পরিচয় নিয়ে। শুনলাম আমার দিদি আমার আসল মা। একদিন মা আমাকে বলেন: ‘কেউ যদি তোমাকে বলে যে তোমার দিদি তোমার মা, তাহলে শুধু হ্যাঁ বোলো। এর থেকে বেশি কিছু আমি বলব না।’

জল্পনার শেষ হয়েছিল তখন?
তত দিনে আমি কত্থক শিখতে শুরু করেছিলাম। নাচের ক্লাসে বলা হত কাজের মেয়ের সন্তান হলে তো এই সব দিকে আমার ঝোঁক থাকার কথা নয়! তা হলে কি আমি কোনও ব্যরিস্টারের মেয়ে? স্কুলের পাঠ অনেক দিন আগেই চুকিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পড়তে ভালবাসতাম। নিজের সঙ্গে একটা ডিকশনারি রাখতাম। আজকে যে আপনার সঙ্গে ইংরাজিতে কথা বলতে পারছি তার কারণও সেটাই। আস্তে আস্তে মেনে নিই যে আমি ‘লাভ চাইল্ড’ (প্রেমজ সন্তান)। আর নিজেকে বোঝাই যে-মহিলা আমাকে দত্তক নিয়ে বড় করেছেন তিনিই আমার মা।

তার পর বার ডান্সার হলেন কী করে?
দিনদিন অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে লাগল। লোকের বাড়িতে মা যেতেন আড্ডা মারতে। কিছু ক্ষণ কথা বলার পরে টাকা চাইতেন। লোকে শেষে আমাদের দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিত। একমাত্র অভিনেত্রী মুমতাজ আর ওঁর মা আমাদের ফিরিয়ে দেননি। তবু কত দিন আর ভিক্ষা করা যায়? শেষে একদিন খবর পেলাম যে প্রাইভেট শো করলে টাকা পাওয়া যায়। আমি কত্থক জানতাম। লেগে পড়লাম। দু’তিন দিন অন্তর অন্তর পাঁচশো-ছ’শো টাকা রোজগার করতাম। প্রাইভেট বাড়িতে মজলিশ বসত। নোট ছড়ানো হত আসরে। মা যেতেন আমার সঙ্গে। এক দিন এক মদ্যপ আমার সঙ্গে অশালীন আচরণ করে। ভয় পেয়ে নাচ করা ছেড়ে দিই। কিন্তু বাড়িতে রোজগার নেই। যখন সাড়ে সতেরো বছর বয়স আমার এক দালালের সঙ্গে আলাপ হয়। আমাকে মুম্বইয়ের হোটেলে পাঠাত। তবে কোনও দিন শহরের বাইরে যাইনি।

কত রোজগার হত?
রোগা, কালো আর সাধারণ দেখতে ছিলাম আমি। আশির দশকে তখন এক রাতে বড়জোর এক হাজার টাকা রোজগার করতাম। সুন্দরীরা সেখানে পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করত। আই ফেইলড ইন প্রস্টিটিউশন।

আপনার মা জানতেন আপনি এ ভাবে রোজগার করতেন?
প্রথমে জানতেন না। যে দিন শুনলেন খুব ভেঙে পড়েছিলেন। অপরাধবোধে ভুগতেন। দশ বছর এ ভাবে চালিয়েছি। ভিক্ষে করিনি। বারে নেচেছি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমার পড়াশুনো। আমি বই পড়তাম। কিন্তু ডিগ্রি নেই। বই পড়া দিয়ে তো আর চাকরি হয় না। এয়ারলাইন্সে ঘুষ দিয়ে চাকরির চেষ্টা করেছি। পাইনি। এমনকী বলেছি সিডিউল কাস্টের কোটাতে যদি চাকরি হয়। লোকে বলল মুসলিমদের মধ্যে সিডিউল কাস্ট আবার কী? এদিকে মা আমাকে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে দেবে না। ইগোর সমস্যা। সতেরো বছর বয়েস থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি ছিলাম যৌনকর্মী। যখন ছাব্বিশ হল, দুবাইয়ের বার-এ নাচতে চলে গিয়েছিলাম।

‘জিসম ২’ ‘আশিকি ২’
আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক আসত আপনার নাচ দেখতে?
দুবাইয়ে তো আন্ডারওয়ার্ল্ড সব জায়গাতেই। যারা আসত তারা খুব বড় বিজনেসম্যান। তাদের মধ্যে কে কী করে আমি কী করে জানব বলুন।

প্রেম এসেছিল জীবনে?
হ্যাঁ। যৌনকর্মী থাকাকালীন অনেকে আমার প্রেমে পড়ে বিয়েও করতে চেয়েছিল। আমি করিনি। দিদির বিয়ের আগে জামাইবাবু বলেছিল মাকে দেখবে। বিয়ের পর সব পালটে গেল। আমার ভয় হত বিয়ে করলে যদি আমার স্বামীও এ রকম হন। দুবাই থেকে ফিরে এলাম কারণ মায়ের ক্যানসার ধরা পরে। ফিরে বিয়ার বারে নাচতে শুরু করি।

বলিউডে কী ভাবে এলেন?
ডান্স বারে থাকাকালীন আমি চিত্রনাট্য লিখতাম। মা মারা যাওয়ার পরে আবার দুবাইয়ে যাচ্ছিলাম তখন একদিন মহেশ ভট্টের ফোন পাই। ‘কলিযুগ’য়ের জন্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে ক’টা দৃশ্য লিখতে বলা হয়। এর পর লিখি ‘ওহ লমহে’। তার পর একে একে ‘আওয়ারাপন’, ‘রাজ ২’, ‘জিসম ২’, ‘মার্ডার ২’, ‘রাজ ৩’, ‘আশিকি ২’। পূজা ভট্টের প্রযোজনায় আমি পরিচালনায় নামব। পাঁচ বছর আগে আমি একটা চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। গল্পটা এক গৃহবধুকে নিয়ে। যিনি ধর্ষিত হন। কিন্তু এই ছবিটা করতে কিছু স্টার লাগবে। তা না হলে আমি অন্য কোনও চিত্রনাট্য লিখব। তাছাড়া পাকিস্তানে শান-য়ের জন্য আমি ‘অর্থ ২’ লিখছি। ‘অর্থ ২’-এর স্ক্রিপ্টটা আমি পাকিস্তানের পটভূমিতে লিখব। পাকিস্তানে আমি আগেও গিয়েছি। তবে এই নিয়ে সাত বার যাচ্ছি।

সংসার করার স্বপ্ন দেখেন?
হ্যাঁ। আজকে জীবনে অনেক কিছু আছে। তবে বাজে ব্যবহার আমি সহ্য করতে পারি না। কারও পিছনে ছুটি না। জীবনে কেউ এলে তাকে আমার পুরোটা জেনে আমাকে গ্রহণ করতে হবে।

পুরনো ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কখনও?
বছর দশেক আগে দেখা হত।

মুমতাজের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনও?
মুম্বই এলে কথা হয়। আর ওঁর ফোন পেলে আমি ছাড়তেই চাই না। অভিনেত্রী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেই ওঁকে আমি দারুণ শ্রদ্ধা করি। ওঁকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তবে উনি বলেন শুধুমাত্র পরিশ্রমের জোরেই আজ আমি এই জায়গায়।

নিজের জীবন নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখবেন?
চিত্রনাট্য নয়, বই লিখতে চাই। তবে তার আগে আমাকে একজন প্রতিষ্ঠিত পরিচালত হতে হবে।

মহেশ ভট্টর সঙ্গে আপনি কেন এত একাত্মবোধ করেন?
আমাদের দু’জনের জীবনটাই খোলা বইয়ের মতো। দু’জনের অবৈধ সন্তান। তাই একে অপরের মানসিক টানাপোড়েন আমরা বেশ ভাল বুঝি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.