সাংবাদিকের ভিড়ে পালানোর আশঙ্কা ছিল, ব্যাখ্যা সরকারের
পায়ে বেড়ি নিয়ে রাজ্যকে দুরমুশ কোর্টের
বার কলকাতা হাইকোর্টের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়ল রাজ্য সরকার। রাজ্যবাসীর মানবাধিকার রক্ষায় সরকার তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কি না, তা নিয়েই বৃহস্পতিবার সংশয় প্রকাশ করেছে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।
উচ্চ আদালতের এই ক্ষোভের মূলে আছে শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসএফআই নেতা সন্তোষ সাহানির পায়ে বেড়ি দিয়ে রাখার ঘটনা। সরকার এ দিন হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানায়, ওয়ার্ডে সংবাদমাধ্যমের বহু প্রতিনিধি ভিড় করায় বন্দির পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই হাসপাতালে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিল ওই ছাত্রনেতার পায়ে।
সরকারের এই বেড়ি-ব্যাখ্যা শুনে ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র বলেন, “রাজ্যে প্রতিদিনই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মানবাধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব তো সরকারের। তাদেরই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।” বেড়ি পরানোর ওই অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থের মামলা করেছেন সৌমেন বিশ্বাস নামে এক আইনজীবী। শুনানির প্রথম দিনেই ওই ঘটনার নিন্দা করে রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিয়ে তাদের বক্তব্য জানাতে বলেছিল ডিভিশন বেঞ্চ।
সন্তোষ সাহানি। —ফাইল চিত্র
সরকার দু’বার সময় নিয়ে এ দিন যে-হলফনামা পেশ করেছে, তাতে হাইকোর্ট সন্তুষ্ট নয়।
আদালতে সরকারের হলফনামার একটি অংশ পড়ে শোনান আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “হাসপাতালে সন্তোষ সাহানির পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখার কারণ রাজ্য সরকার কী ভাবে ব্যাখ্যা করেছে শুনুন। সরকার বলছে, ‘হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে সংবাদমাধম্যের প্রতিনিধিরা যে-ভাবে ভিড় করছিলেন, তাতে অভিযুক্তের পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তাঁর পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিল।’ সরকার কতটা অমানবিক, এতেই তা পরিষ্কার।”
ব্যাখ্যা শুনে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী সরকারি আইনজীবী সুব্রত তালুকদারের উদ্দেশে বলেন, “হাতে হাতকড়া কিংবা পায়ে বেড়ি পরানোর ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের কী রায় আছে, আপনি কি তা জানেন? ওই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট আলফা জঙ্গিদেরও হাতে হাতকড়া এবং পায়ে বেড়ি পরাতে নিষেধ করে দিয়েছে।” এখানেই থেমে থাকেননি বিচারপতি বাগচী। তিনি বলেন, “পুলিশ যাঁকে গ্রেফতার করেছে, তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনের নেতা। পুলিশি নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও সেই নেতা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাবেন, এই যুক্তি কি বিশ্বাসযোগ্য?”
এর পরেই ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ তোলে ডিভিশন বেঞ্চ। প্রথমে ১০ হাজার টাকার কথা উঠলেও বিচারপতি বাগচী বলেন, “না, না। অন্তত ১৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতেই হবে।” তবে এ ব্যাপারে হাইকোর্ট এ দিন কোনও চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়নি। রায় পরে ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়ে দেন দুই বিচারপতি।
সন্তোষের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল?
১০ এপ্রিল শিলিগুড়িতে সিপিএম এবং তৃণমূলের মিছিল ঘিরে সংঘর্ষ হয়। পরে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, সিপিএমের ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার-সহ ৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সে-রাতেই অশোকবাবু-সহ তিন জনকে জামিন পান। পরের দিন শর্তসাপেক্ষে জামিন পান পাঁচ মহিলা। বাকি ৪৬ জনকে জেলে রাখা হয়। তাঁদের মধ্যে সন্তোষ-সহ তিন জন জেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জেল-কর্তৃপক্ষ ১৫ এপ্রিল সকালে সন্তোষকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। সে-দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সন্তোষ মুক্ত থাকলেও রাতে তাঁর পায়ে বেড়ি পরানো হয় বলে অভিযোগ। সন্তোষের পাহারার দায়িত্বে ছিলেন এক জন কারারক্ষী। তিনিই ওই বেড়ি পরিয়ে দেন বলে অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে কারা দফতর, হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের মধ্যে চাপান-উতোর শুরু হয়। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তার পরেই সন্তোষের বেড়ি খুলে দেন। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়।
হাইকোর্ট এ দিন রায় না-দিলেও তাদের পর্যবেক্ষণে খুশি শিলিগুড়ি সূর্য সেন কলেজের কলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সন্তোষ এবং তাঁর পরিবার। সন্তোষ বলেন, “আমার উপরে যে অমানবিক অত্যাচার হয়েছে, হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণেই সেটা স্পষ্ট। যারা ক্ষমতায় রয়েছে, তারা মিথ্যে অভিযোগ এনে অত্যাচার চালাতে চেয়েছিল। আসল ছবিটা এখন সকলেই বুঝতে পেরেছেন। বিচার ব্যবস্থার উপরে আমার বিশ্বাস বেড়ে গেল।” ওই এসএফআই নেতার অভিযোগ, পুলিশ তাঁর উপরে মানসিক নির্যাতনও চালিয়েছে।
শিলিগুড়ির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে শ্রবণনগরের বাসিন্দা সন্তোষের মা ফুলদেবী বলেন, “হাসপাতালে আমার অসুস্থ ছেলেটার পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিল। মা হয়ে আমাকে তা দেখতে হয়েছে। এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে আদালত যে-মন্তব্য করেছে, তাতে আমরা খুশি।”
খুশি সন্তোষের দল সিপিএম-ও। ওই দলের দার্জিলিং জেলা নেতা তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবু বলেন, “আমরা খুবই খুশি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্যকে গুরুত্বই দিচ্ছে না সরকার। এই অবস্থায় হাইকোর্ট যা বলল, তাতে এটাই স্পষ্ট হল যে, রাজ্যের মানবাধিকার ভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। টাকাটা বড় কথা নয়। আদালতের পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং আমাদের কাছে তা অত্যন্ত সন্তোষজনক।” হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণকে স্বাগত জানিয়েছে এসএফআই-ও।
কিন্তু আদালতের তিরস্কারে সরকারের টনক নড়বে কি না, সেই বিষয়ে তাদের সংশয় আছে।
তাদের অভিযোগ, আদালতের রায় না-মানার নজির তৈরি করে চলেছে সরকার। তাই এ ক্ষেত্রেও হাইকোর্টের বক্তব্যকে তারা আমল দেবে কি না, সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। আদালতের এই বক্তব্যকে মর্যাদা দেওয়া এবং পুলিশি হেফাজতে সংগঠনের অন্যতম নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে ২ অগস্ট কলকাতায় মিছিল করবে এসএফআই।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.