ভোট দিলেন পাক্কা বছর কুড়ি বাদে। ভোটের কালি-লাগা আঙুল দেখালেন। চকচক করে উঠল প্রাক্তন জঙ্গির চোখ।
বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ির কুমারগ্রাম পঞ্চায়েতের উত্তর হলদিবাড়ি প্রাথমিক স্কুলের বুথ থেকে বেরিয়েই প্রাক্তন কেএলও (কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন) নেতা মিল্টন বর্মা ওরফে মিহির দাস বললেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামিল হয়ে দাবি আদায়ের স্বপ্ন দেখছি। তাই ভোট দিলাম। যে সব কেএলও নেতা-কর্মী এখনও আত্মগোপন করে রয়েছেন, তাঁদেরও মূলস্রোতে ফেরার ব্যবস্থা করে দিক রাজ্য সরকার, এই আর্জি রইল।”
তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন মিল্টন। পারিবারিক পাঁচ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালাচ্ছেন। স্ত্রী চন্দনা
|
মিল্টন বর্মা |
|
সুমিত্রা বর্মন |
বলেন, “এক সময়ের জঙ্গির এখন সংসারে মন বসেছে।” মুচকি হেসে মিল্টন বলেন, “একে-৪৭, একে-৫৬ আর তুলে নেব না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে ভরসা রয়েছে। রাজবংশী অ্যাকাডেমি করেই দিয়েছেন উনি। আশা করি, রাজবংশী ভাষার স্বীকৃতিও দেবেন।”
এক সময়ে কেএলও-র প্রথম সারির এই নেতা একা নন, গণতন্ত্রের পথে ভরসা রেখে এ বার ভোট দিয়েছেন দলে মিল্টনেরই প্রাক্তন সহকর্মী বাবুরাম মারাণ্ডি ওরফে শৈলেন রায়।
২০০৩-এ ভুটান থেকে ধরা পড়া শৈলেন জামিন পান ২০০৯ সালে। ফালাকাটার কড়াইবাড়ির বাসিন্দা বছর বত্রিশের এই যুবক এখন সরকারি মধ্যস্থতায় ঋণে কেনা গাড়ি চালিয়ে উপার্জন করছেন। মিল্টনের মতো শৈলেনও বলছেন, “কেএলও চিফ জীবন সিংহের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাঁকেও মূলস্রোতে ফেরানোর ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার।” দুই প্রাক্তন কেএলও-রই আশা, রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার সুযোগ মিললে সমাজের মূলস্রোতে ফিরবেন, বাড়ি ফিরবেন তাঁদের
পুরনো সতীর্থেরা।
১৯৯৫-এ ‘অল কামতাপুর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-এর একাংশ যখন কেএলও গড়ে, সংগঠনের প্রধান হন কুমারগ্রামের হলদিবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা জীবন সিংহ ওরফে তমির দাস। প্রথম দিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভরসা রাখলেও অচিরেই সশস্ত্র পথ বাছে কেএলও। ২০০০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ময়নাগুড়ি, কুমারগ্রাম, ধূপগুড়ি এলাকা তেতে ওঠে কেএলও-জঙ্গিদের তৎপরতায়। পরে প্রশাসনিক অভিযানের মুখে এ রাজ্যে কেএলও কোণঠাসা হয়। সংগঠনের অনেক শীর্ষ নেতাই ধরা পড়েন। ১৯৯৯-এ ধরা পড়লেও পরে পালিয়ে যান জীবন সিংহ। এখনও তিনি অধরা। প্রাক্তন কেএলও জঙ্গিদের মধ্যে যাঁরা মূলস্রোতে ফেরার লড়াই এখনও চালাচ্ছেন, তাঁদের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, পুনর্বাসন দেওয়া নিয়ে প্রশাসনিক গড়িমসিতে হতাশ হয়ে তাঁদের অনেক পুরনো সহকর্মী হয়তো জীবন সিংহের নেতৃত্বে কেএলও-কে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। পুলিশও মানছে, তেমন সম্ভাবনা রয়েছে বলে।
মিল্টনের বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই বাড়ি জীবনের। দরমার বেড়া ও টিনের চাল দেওয়া জীর্ণ ঘরদোর। আগাছা গজিয়েছে চত্বরে। জীবনের বাবা বহু আগেই মারা গিয়েছেন। মা মারা গিয়েছেন মাস পাঁচেক আগে। পাঁচ বোনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট বোন সুমিত্রা বর্মনও প্রাক্তন কেএলও জঙ্গি। থাকেন বারোবিশার ভলকা গ্রামে। তিনিও ভোট দিয়েছেন এ দিন। “অস্ত্র দিয়ে সব হয় না’’, উপলব্ধি সুমিত্রার। বছর তিরিশের বধূটির আক্ষেপ, “কী দশা হয়েছে বাপের বাড়িটার! মাঝে-মধ্যে এসে দেখে যাই, কিন্তু তাতে কী আর বাড়ি রাখা যায়?” তাঁর সংযোজন, “দাদা, বৌদি (কেএলও নেত্রী ভারতী দাস) এবং দুই ভাইঝিরিন্টি আর বুল্টি ফিরে আসুক। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলুক। রাজ্য সরকার চাইলে বাড়িটা বাড়ির মতো দেখাবে, এর বেশি চাওয়ার নেই।” |