রাত পৌনে ১২টা
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মোড় থেকে রাসবিহারী মোড় পর্যন্ত পুরোটাই সুনসান। পুলিশের টহলদারির বালাই নেই। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মোড়ে অবশ্য পুলিশের একটি ব্যারিকেড রয়েছে। সেখানে মোটরবাইক ও গাড়ির নথিপত্র পরীক্ষা করছেন তিন পুলিশকর্মী। কিন্তু তার পর থেকে গোটা রাস্তায় কোনও পুলিশি টহলদারি না থাকায় কার্যত অরক্ষিত গোটা এলাকা।
রাত ১২টা ১৫
গুরুসদয় দত্ত রোডে ঢোকার মুখেই একটি রেস্তোরাঁর সামনে চলছে পুলিশের ‘চেকিং’। উপযুক্ত প্রমাণপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখালে তবেই মিলছে এগোনোর অনুমতি। কিন্তু তার পরে আলো-আঁধারি রাস্তা জুড়ে কোথাও কোনও পুলিশের টহলদারি ভ্যানের দেখা নেই। রাস্তার পাশে একটি বহুতলের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়াতেই বাইরে বেরিয়ে এলেন নিরাপত্তারক্ষী। জানতে চাইলেন, ‘আপনারা কারা?’ সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি যা জানালেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে, ওই রাস্তার মোড়ে কালেভদ্রে পুলিশের নজরদারি চললেও গোটা এলাকা প্রতিদিনই কার্যত অরক্ষিত থাকে। পথচারীর সঙ্গে অপ্রীতিকর কাণ্ড ঘটিয়ে আততায়ীরা এলাকার যে কোনও গলি ধরে চম্পট দিতেই পারে।
ওই রক্ষীই জানালেন, কয়েক মাস আগে গুরুসদয় দত্ত রোডের একটি বহুতলের সামনে খুন হন কড়েয়ার বাসিন্দা এক গাড়িচালক। বহুতলের বাইরে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১১টা ৫৩ মিনিটে তিন যুবক ওই গাড়িচালককে মারধর করছে। এবং ওই চালক মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরেই এলাকারই একটি গলিতে ঢুকে পড়ছে ওই তিন যুবক। ওই ঘটনার সময়ে যেমন এলাকা অরক্ষিত ছিল, তেমনই বুধবার রাতেও কিন্তু ওই রাস্তায় পুলিশের কোনও নজরদারি চোখে পড়েনি। |
রাত ১২টা ৩০
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ও গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থলে চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের সামনে পুলিশের একটি ব্যারিকেড। সেখানে বসে খাকি উর্দির দুই পুলিশকর্মী। তাঁদের সামনে দিয়েই ধর্মতলার দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে গেল তিন সওয়ারির দু’টি মোটরবাইক। ছ’জনের কারও হেলমেট নেই। শুধু তা-ই নয়, বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলেছে মালবোঝাই লরিও।
রাত ১টা
বিডন স্ট্রিট এলাকায় পুলিশের বুথের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখা গেল পাঁচ যুবককে। পাশে দু’টি মোটরবাইক। কিছুক্ষণ গল্প করার পরে বেপরোয়া গতিতে বিকট আওয়াজ তুলে দু’টি মোটরবাইকই বেরিয়ে গেল উত্তরমুখী। এলাকায় পুলিশের টহলদারি ভ্যান বা বাইক নিয়ে পুলিশকর্মী দেখা গেল না, যাঁরা ওই যুবকদের বাধা দিতে পারেন।
বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, বুধবার রাতে শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর ঘুরে সর্বত্রই চোখে পড়েছে এলাকা অরক্ষিত থাকার এই ছবি। পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস ময়দান মোড়, সিআইটি রোডের মোড়, এ জে সি বসু রোড, এলগিন রোড-সহ শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে মোটরবাইক-বাহিনীকে জব্দ করতে পুলিশের ব্যারিকেড কিংবা চেকিং থাকলেও তার পর থেকে বেশ খানিকটা রাস্তা জুড়ে রয়ে গিয়েছে আতঙ্কের পরিবেশ। যা কলকাতার চেনা ছবি বলেই দাবি বাসিন্দাদের। |
যেমন, রবীন্দ্র সরোবরের চার রাস্তার মোড়ে সিগন্যাল জ্বলছে নিভছে। আর সেখান দিয়েই নিজেদের ইচ্ছেমতো ছুটে চলেছে চার চাকার যান। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ট্যাক্সি। তার মধ্যেই বসেছে নেশার আসর। যার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কড়া গলায় এক জন বলে উঠেছেন, ‘‘এখানে কী চাই?’’
আবার রাত ১১টা নাগাদ হেস্টিংস এলাকায় সেতুর নীচে ফাঁকা জায়গায় এক-একটি মোটরবাইকে দুই-তিন জন যুবক চেপে চলছে রেস। বিকট তার আওয়াজ। কোথাও পুলিশ নেই। রাতেও খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জে বাজার জমজমাট। তবে সিআইটি রোড, মৌলালি, রাজাবাজার, গল্ফ গ্রিন, যোধপুর পার্ক, সাদার্ন অ্যাভিনিউ, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-সহ বিভিন্ন এলাকাই ছিল কার্যত অরক্ষিত।
দক্ষিণ কলকাতায় মোটরবাইক চেকিং করা এক পুলিশ অফিসার যুক্তি দিয়েছেন, “রাস্তার মোড়ে চেকিং হচ্ছে। তার পরে এলাকায় আর কিছু হবে না বলেই মনে হয়। এমন ভাবে এলাকায় ঢোকা ও বেরোনোর রাস্তায় নজরদারি রয়েছে যে কেউ যেমন ঢুকতেও পারবে না, তেমনই দুষ্কর্ম করে বেরোতেও পারবে না।”
রাস্তার মোড়ে নজরদারি থাকলেও এলাকায় রাতে টহলদারি না থাকার বিষয়ে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “বাইক-বাহিনীকে শায়েস্তা করতেই গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সব এলাকায় পুলিশ দেওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনই কোনও এলাকা থেকে খবর পেয়েই পুলিশ যাতে সেখানে দ্রুত পৌঁছতে পারে, সে জন্য টহলদারি বাড়ানো হবে।” পুলিশ সূত্রের খবর, বুধবার রাতে আইন ভাঙায় কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ-পূর্ব শাখায় ১৫৮ জন বাইক-আরোহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। |