এক-একটি মোটরবাইকে দু’তিন জন করে সওয়ারি। হেলমেটের বালাই নেই। বাইকগুলির গতিও যেমন বেশি, আওয়াজও তত। হয় ফাঁকা রাস্তায় বাইকের রেস, নয়তো রেস্তোরাঁ, শপিং মল বা মাল্টিপ্লেক্সের কাছে ঘুরঘুর। রাতের কলকাতায় এ ছবি এখন বছরভরের। বাইক সওয়ারিদের নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করবে কারা?
সকলেই বলবেন, পুলিশ। কিন্তু রাতের কলকাতায় তাদের কোথায় পাওয়া যাবে? এমন প্রশ্নও নতুন নয়, দীর্ঘ দিনের। কিন্তু রাতের শহরের মাত্র একাংশের ছবি শহরবাসীর অভিযোগকেই আরও স্পষ্ট করল।
পার্ক স্ট্রিটে এক মহিলার শ্লীলতাহানি-কাণ্ডে সরগরম হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি। তাই এ দিনের রাত-সফর শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। রাত সওয়া দশটা থেকে রাতভর পার্ক স্ট্রিট এলাকার হোটেল, রেস্তোরাঁ সংলগ্ন এলাকায় অবশ্য পুলিশ না-থাকার অভিযোগ খাটল না। দু’তিনটে মোড়ে পুলিশ পিকেটিং থেকে মোটরবাইকে করে এলাকায় নজরদারি রাখা হচ্ছে।
ব্যস ওইটুকুই!
কারণ, তার পরে দক্ষিণ কলকাতামুখী গুরুসদয় দত্ত রোড কিংবা এলগিন রোড, শরৎ বসু রোড-সহ একাধিক ছোট-বড় গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় কোনও মোটরবাইকে, কিংবা গাড়ি চড়ে পুলিশি নজরদারি চোখে পড়েনি। অথচ, এই সব রাস্তাতেও একাধিক রেস্তোরাঁ রয়েছে, রয়েছে শপিং মল-মাল্টিপ্লেক্স। ফলে রাত অবধি যথেষ্ট মানুষের আনাগোনা থাকে এ সব এলাকায়। প্রহরাবিহীন কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যেখানে অনেক রাত পর্যন্ত জনসমাগম হয়, সে সব পাড়াতেও পুলিশের উপস্থিতির কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেমন আনোয়ার শাহ রোড থেকে লেক গার্ডেন্স উড়ালপুলের দিকে যাওয়ার মোড়ের কাছে দু’দিকে রাস্তায় রাত এগারোটার পরে রীতিমত গা-ছমছমে পরিবেশ। কোনও ঘটনা ঘটলেও দেখার কেউ নেই।
|
একটি মাল্টিপ্লেক্সের কাছে রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার ছবিটাও বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিল। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা এক ট্যাক্সিচালক ভোলা মণ্ডল জানান, ইদানীং রাতের যাত্রী-সংখ্যা কমে যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও লাভ হচ্ছে না। কিন্তু কেন? ভোলাবাবু বলেন, “আগে সিনেমার নাইট শো-তে ভালই দর্শক হত। মহিলাদের সংখ্যাও ছিল বেশ। কিন্তু চার দিকে যা হচ্ছে! রাতে বেরোতে লোকজন ভয় পাচ্ছেন।”
ওই ট্যাক্সিচালকের এই অভিযোগ যে অমূলক নয়, সাউথ সিটি মল এলাকা থেকে দক্ষিণ কলকাতার একাধিক রেস্তোরাঁ, হোটেলগুলির কাছেও তারই প্রমাণ মিলল।
কিন্তু কীসের ভয়? কয়েকটি উদাহরণেই তা স্পষ্ট হল। লর্ডসের মোড়, রাত সওয়া এগারোটা। চার মাথার মোড়ের মধ্যে দু’টি রাস্তায় বেশ কিছু যাত্রী বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। তার মধ্যে কয়েক জন মহিলাও ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হাতে গোনা কয়েকটি অটো ও ট্যাক্সি চোখে পড়ল। চার দিকের দোকান ও রেস্তোরাঁর সামনে অবশ্য স্থানীয় কিছু যুবকের ভিড় এবং একটি ‘বাইক গ্যাং’। কমপক্ষে ছ’সাতটি মোটরবাইক একটি দোকানের সামনে দাঁড় করানো, সেখানে জনা চার পাঁচ যুবক দাঁড়িয়ে গল্প করছেন, কেউ বা ঠান্ডা পানীয় খাচ্ছেন। কিন্তু দু’টি মোটরবাইক ওই মোড়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আর একটি মোটরবাইক সেখানে এসে দাঁড়াচ্ছে। তার পরে দু’টি মোটরবাইক বেপরোয়া গতিতে রাস্তায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে চলে গেল সাউথ সিটি মলের দিকে।
ওই মোড়েই অপেক্ষা করছিলেন রুবি পার্কের বাসিন্দা শোভন দে। তিনি বলেন, “রাতে এই মোড়ে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে ভয় লাগে। পুলিশ তো চোখে পড়ে না। কে এদের আটকাবে!”
পুলিশ চোখে পড়ল। তবে তার জন্য অবশ্য যেতে হল রবীন্দ্র সরোবর, শরৎ বসু রোড হয়ে আজাদ হিন্দ ধাবা পেরিয়ে বালিগঞ্জ ধাবার দিকে। সেখানে গিয়ে মোটরবাইকে সওয়ার পুলিশের দেখা মিলল।
শুধু দক্ষিণ কলকাতাই বা কেন? চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, রবীন্দ্র সরণি, মহাত্মা গাঁধী রোড, এ জে সি বসু রোডে হেলমেট-বিহীন দু’তিন জন সওয়ারিতে ঠাসা মোটরবাইকের বেপরোয়া চলাচল অন্তত রাত দেড়টা পর্যন্ত চোখে পড়েছে। ব্যতিক্রম নয় পূর্ব কলকাতাও। বিশেষত ফুলবাগানে স্বভূমি, ই এম বাইপাস সংলগ্ন মণি স্কোয়ার মল-সহ একাধিক জায়গায় অরক্ষিত কলকাতা হয়ে উঠছে মোটরবাইক বাহিনীর মুক্তাঞ্চল।
কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার মোড় কিংবা বি বা দী বাগ। সেখানে পুলিশ না থাকার অভিযোগ কেউ করবে না। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতিতেই বাইকবাবুদের দেখা গেল স্বমূর্তিতে। টের পেলেন অন্যান্য গাড়িচালক, পেল না শুধু পুলিশ। ও দিকে বি বা দী বাগে পুলিশ সক্রিয় হল, কারণ খাস মহাকরণের কাছেই মিনিবাসের মধ্যে প্রবল গোলমালের আওয়াজ পেয়ে পিছু ধাওয়া করলেন এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। এক মহিলা যাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে সেখানে ধরা হল এক যুবককে।
রাতে টহলদারি নেই কেন? কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “পঞ্চায়েতের কাজে বড় সংখ্যক পুলিশকর্মী চলে যাওয়ায় নজরদারিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। ভোটের পরে তাঁরা ফিরে এলে নজরদারি আবার আগের মতো হবে।” তবে বাইক বাহিনীর ‘দাপট’ নিয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি তাঁর কাছে। |