দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত নড়ে বসল পুলিশ। ফুলবাগানে নাবালিকাকে আটকে রেখে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত আইনজীবী লাভলি চাড্ডা, আইনজীবী সব্যসাচী রায়চৌধুরী এবং লাভলির স্বামী (গোয়েন্দাদের একাংশের মতে স্বামী নয়, সঙ্গী) সুব্রত মিশ্রকে বুধবার গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ওই কিশোরীর মা-ও। ফলে এফআইআরে যে ছ’জনের নাম আছে, তাঁদের মধ্যে ওই কিশোরীর সৎ-বাবা উত্তম দাস ও মিলন নামে এক পুলিশ অফিসার বাদে সকলকেই গ্রেফতার করল পুলিশ। উত্তম এখনও বেপাত্তা। মিলনকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
|
সব্যসাচী রায়চৌধুরী |
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “লাভলি চাড্ডা ও তাঁর স্বামী সুব্রত মিশ্র রাতে ফুলবাগান থানায় এসে ধরা দেন।” পুলিশ সূত্রের দাবি, লাভলির বাড়ির ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিলেন, রোহিত গুপ্ত নামে এক গাড়িচালক গত ক’দিন ধরে লাভলির গাড়ি চালাচ্ছেন। রোহিতের মোবাইল নম্বর জেনে নিয়ে সেটির টাওয়ার লোকেশন নজর করতে শুরু করেন গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার রাতে দেখা যায়, রোহিতের মোবাইলটি রয়েছে লিলুয়া-বেলুড় এলাকায়। ধরে নেওয়া হয়, রোহিতের সঙ্গেই রয়েছেন লাভলি-সুব্রত। কিন্তু অবস্থান নির্দিষ্ট ভাবে বোঝা যায়নি বলে গোয়েন্দাদের রাতে অভিযান চালাতে বারণ করে লালবাজার। বুধবার দুপুরে দেখা যায়, মোবাইলটি রয়েছে বোলপুর এলাকায়। ঘটনাচক্রে, লাভলি সেই সময়েই নিজের মোবাইল অন করেছিলেন। পুলিশ তৎক্ষণাৎ লাভলিকে ফোন করে ফুলবাগান থানায় এসে আত্মসমর্পণ করতে বলে। সূত্রের দাবি, পুলিশের ফোন পেয়ে লাভলি পাল্টা জানতে চান সব্যসাচী গ্রেফতার হয়েছেন কি না। পুলিশ জানায়, সব্যসাচী ধরা পড়েছেন। এর পর রাতের দিকে ফুলবাগান থানায় আত্মসমর্পণ করেন লাভলি ও সুব্রত।
সব্যসাচীকে পাকড়াও করা হয় এ দিন দুপুর ১টা নাগাদ, কাঁকুড়গাছির একটি ধাবার সামনে থেকে। পুলিশের দাবি, তাঁকে ধরার জন্য ফুলবাগান ও কাঁকুড়গাছি এলাকায় সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। যদিও মঙ্গলবার সব্যসাচীকে শিয়ালদহ কোর্ট ও ভবানী ভবনে দেখা গিয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি। নির্যাতিতার মা সঙ্গীতাকে ধরা হয় কেষ্টপুরের হানাপাড়া থেকে। তাঁকেও মঙ্গলবার প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল বলে খবর।
পুলিশ সূত্রের দাবি, সঙ্গীতা ও তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী উত্তম দাস হানাপাড়া এলাকায় ভাড়া থাকেন বলে বিধাননগর কমিশনারেট থেকে জানানো হয়েছিল। সেই মতো এ দিন সকালে ফুলবাগান থানার দুই অফিসার হানাপাড়ায় যান। কিন্তু তাঁরা গিয়ে জানতে পারেন, বাগুইআটি থানার পুলিশ আগেই সঙ্গীতাকে আটক করে নিয়ে গিয়েছে। পরে বাগুইআটি থানা সঙ্গীতাকে ফুলবাগান থানার হাতে তুলে দেয়। লালবাজারে নিয়ে গিয়ে দুই অভিযুক্তকে জেরা করেন গোয়েন্দারা। ধৃতদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, মারধর, শ্লীলতাহানি, অন্যায় ভাবে আটকে রাখা, খুনের হমকি দেওয়ার অভিযোগ এনেছে পুলিশ। যৌন অত্যাচার থেকে শিশুদের রক্ষা সংক্রান্ত আইন এবং শিশু নিরাপত্তা আইনেও আলাদা অভিযোগ আনা হয়েছে। |
গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ মঙ্গলবার বলেছিলেন, “নির্দিষ্ট প্রমাণ মিললেই সব্যসাচীকে গ্রেফতার করা হবে।” বুধবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা কি প্রমাণ পেয়েছেন? উত্তরে পল্লববাবু ‘হ্যাঁ’ বলেন। লালবাজার সূত্রের খবর, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিকের কাছে নির্যাতিতা নাবালিকা যে চিঠিটি লিখেছিল, তার সঙ্গে পুলিশকে দেওয়া তার বয়ান
মিলে যাওয়ায় পুলিশের উপরমহল থেকে অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হয়। লালবাজার সূত্রের খবর, মিলন নামের তিন জন পুলিশ অফিসারকে প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক কর্তা জানান, আসল অভিযুক্তের হদিস পেতে কিশোরীটিকে ওই তিন জনের ছবি দেখানো হতে পারে।
নির্যাতিতা কিশোরীকে এ দিন বিকেলে লালবাজারে নিয়ে আসা হয়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তার চিঠি এবং পুলিশকে দেওয়া বয়ান খতিয়ে দেখে মনে করা হচ্ছে, তার অভিযোগের মধ্যে কোনও অতিশয়োক্তি নেই। গোয়েন্দাদের দাবি, নানা ভাবে যৌন নির্যাতন চালানো হলেও এখনও পর্যন্ত কেউ তার সঙ্গে সহবাস করেনি বলে পুলিশকে জানিয়েছে ওই নাবালিকা। এ দিন শিয়ালদহ আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সে গোপন জবানবন্দিও দিয়েছে। পুলিশকে কী জানিয়েছে কিশোরী? লালবাজার সূত্রের খবর, সে বলেছে, লাভলির বাড়িতে মদের আসরে এবং অন্যান্য সময়ে তার গোপন অঙ্গে হাত দেওয়া হত। আগে তার সৎ-বাবাও এমন আচরণ করেছেন। গোয়েন্দাদের মতে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিককে লেখা চিঠিতে সুব্রত মিশ্রের বিরুদ্ধে কিশোরীটি যে সব অভিযোগ করেছে, তা যৌন নির্যাতনেরই সামিল। মেয়েটি পুলিশকে জানায়, জানুয়ারি থেকে ১৪ মার্চের আগে পর্যন্ত লাভলির বাড়িতে ছিল সে। নির্যাতন করা হয় তখনই। ১৪ মার্চ বন্ধু রামকৃষ্ণের সঙ্গে পালায় সে। এর পরে ফুলবাগান থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন লাভলি।
প্রশ্ন উঠেছে, মার্চে যদি মেয়েটি পালিয়ে আসে, তা হলে ফুলবাগান থানায় অভিযোগ জানাতে চার মাস লাগল কেন? শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারীর অভিযোগ, ফুলবাগান থানায় জমা পড়ে ১৯ জুলাই। মেয়েটি পুলিশের কাছে দাবি করে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোমে থাকাকালীন কাউন্সেলিংয়ের সময় অনেককে সে তার ঘটনা জানিয়েছিল। কেউ কিছু করেনি। সম্প্রতি জেরি নামে এক আইরিশ মহিলা কাউন্সেলিং করতে এলে তাঁকেও সব ঘটনা জানায় সে। ওই বিদেশিনিই তখন বলেন, ঘটনাটি পুলিশকে জানানো দরকার। তার পরেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শিশুকল্যাণ সমিতিকে জানায়। এই দেরির জন্য সংস্থাটিকে শো-কজ ও কালো তালিকাভুক্ত করা হবে বলে শিশুকল্যাণ সমিতি জানিয়েছে। |