নাবালিকা নিগ্রহের অভিযোগ জমা পড়ার পর এফআইআর দায়ের করতেই দু’দিন লেগে গিয়েছিল পুলিশের। সোমবার তা নিয়ে আদালতের ভর্ৎসনার পরেও তাদের তেমন নড়েচড়ে বসার লক্ষণ নেই। এফআইআরে যে পাঁচ জনের নাম রয়েছে, তাঁদের কেউ মঙ্গলবারও গ্রেফতার হননি। যদিও এক অভিযুক্তকে এ দিন শিয়ালদহ আদালতে এবং ভবানী ভবনে দেখা গিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি। যে অভিযুক্তের পরিচয় অস্পষ্ট, তাঁকেও চিহ্নিত করা যায়নি।
নাবালিকাকে অত্যাচার এবং যৌন নিগ্রহ নিয়ে শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারীর অভিযোগ ফুলবাগান থানায় জমা পড়ে ১৯ জুলাই। কিন্তু পুলিশ এফআইআর দায়ের করে ২১ তারিখ। এফআইআরে নাম রয়েছে, কিশোরীটি যাঁর বাড়িতে থাকত, সেই লাভলি চাড্ডা, লাভলির স্বামী (পুলিশের একাংশ বলছে, স্বামী নয় সঙ্গী), সব্যসাচী রায়চৌধুরী, মিলন (কিশোরীর দাবি অনুযায়ী পুলিশ অফিসার) এবং নির্যাতিতার মা ও সৎ বাবার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ এ দিন বলেন, “এফআইআরে নাম থাকা অভিযুক্তরা পলাতক। ওই নাবালিকা যে পুলিশ অফিসারের নামে অভিযোগ করেছে, তাঁকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।”
কিন্তু আইনজীবী মহলের একাংশের দাবি, পেশায় আইনজীবী লাভলি ও সব্যসাচী সোমবার শিয়ালদহ কোর্টে (যেখানে এই মামলার শুনানি হয়) এসেছিলেন। মঙ্গলবার লাভলি না-এলেও ফের আসেন সব্যসাচী। মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি তুলতে। পরে তাঁকে ভবানী ভবনেও দেখা যায় বলেও সিআইডি-র একটি সূত্র জানিয়েছে। ফলে হাতের কাছে পেয়েও পুলিশ কেন তাঁদের ধরল না, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। |
প্রতিবাদ। মঙ্গলবার ফুলবাগান থানার সামনে। ছবি: শৌভিক দে। |
আনন্দবাজারের তরফেও সব্যসাচীর সঙ্গে এ দিন কথা বলা হয়। গোয়েন্দা-প্রধানের অবশ্য দাবি, সব্যসাচী যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শিয়ালদহ আদালতের বার অ্যাসোসিয়েশন যদিও ইতিমধ্যেই সব্যসাচীকে শো-কজের নোটিস দিয়েছে।
তবে ফুলবাগান থানার যে গাফিলতি রয়েছে, পরোক্ষে তা মেনে নিয়েছেন লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা। পুলিশ সূত্রের খবর, ফুলবাগান থানার হাত থেকে তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার রাজারহাটে মেয়েটির মাসির বাড়িতে গিয়ে কথা বলেন তদন্তকারী অফিসারেরা। ঘটনাচক্রে, এ দিনই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছে মহিলা কমিশন। কমিশন সূত্রের খবর, ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ সত্যি কি না, তা তদন্ত করে পুলিশ কমিশনারকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশের কপি গিয়েছে শিশুকল্যাণ সমিতির কাছেও।
লালবাজারের অবশ্য দাবি, তদন্ত কিছুটা এগিয়েছে। সোমবার রাতেই ফুলবাগান থানায় গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (৪) প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তদন্ত শুরু করতে কেন দেরি হল, কেনই বা অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হল না, থানার অফিসারদের কাছে সে কথা জানতে চান প্রদীপবাবু।
কী যুক্তি দিয়েছে থানা?
লালবাজার সূত্রের খবর, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে থানার ওসি জানান, মামলার তদন্তকারী অফিসার সুব্রত কর ওই সময়ে লাভলিরই ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির মেয়েকে অপহরণের মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলেন। তাই তদন্তে দেরি হয়েছে। ওই অফিসার শহরে ফিরে এসে সোমবার আদালতে লিখিত আবেদন করে জানান, বিচারক যেন ওই নাবালিকার গোপন জবানবন্দি গ্রহণ করেন। কিন্তু বিচারক সেই আর্জি খারিজ করে দেন। আদালত সূত্রের খবর, ফুলবাগান থানা এ দিন ফের গোপন জবানবন্দি নথিভুক্তির আর্জি জানালে তা মঞ্জুর করা হয়। আজ, বুধবার নির্যাতিতা কিশোরীকে গোপন জবানবন্দির জন্য আদালতে হাজির করানো হতে পারে।
লালবাজারের এক কর্তা জানান, মেয়েটি মিলন নামের যে পুলিশ অফিসারের নামে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করেছে, তিনি কলকাতা পুলিশের কোনও অফিসার কি না, তা জানার চেষ্টা চলছে। পুলিশ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই মিলন নামের জনা তিনেক অফিসারকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখা হয়েছে। প্রথমে তাঁদের ছবিই নির্যাতিতাকে দেখানো হবে। বছর চারেক আগে মিলন নামে এক অফিসার ফুলবাগান থানায় কর্মরত ছিলেন বলে লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা জেনেছেন। |
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে লেখা নির্যাতিতার সেই চিঠির একাংশ। |
পুলিশের একাংশের এমনও দাবি, সব্যসাচীর সঙ্গে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের কিছু অফিসারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তিনি গ্রেফতার হলে ওই অফিসারদের নাম প্রকাশ্যে আসতে পারে। তাঁকে গ্রেফতার করা নিয়ে গড়িমসির এটাও একটা কারণ হতে পারে বলে ওই সূত্রের অভিমত।
যদিও পুলিশেরই অন্য একটি অংশ সেই সম্ভাবনা খারিজ করে বলছে, মেয়েটি যে লাভলির বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে, তা প্রায় আড়াই মাস আগে সব্যসাচীই ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে জানান। তিনি ওই সংস্থার ঘনিষ্ঠ। তার পর কিশোরীটিকে উদ্ধার করে যখন ওই সংস্থার আশ্রয়ে রাখা হয়, তখন তিনি নিয়মিত তার খোঁজখবর নিয়েছেন।
নিয়মমাফিক কিশোরীটিকে যে দিন শিশুকল্যাণ সমিতির সামনে হাজির করা হয়েছিল, সে দিন সেখানে সব্যসাচী উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই দিন কিশোরীটিকে ধমক-ধামক দিতে দেখা যায় সব্যসাচীকে। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই নাবালিকাকে নিয়ে শিশুকল্যাণ সমিতিতে অভিযোগ জানাতে নিয়ে যাওয়ার দিন সব্যসাচীকে সে ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর পুলিশের কয়েক জন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার একাংশের উপরে চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেকের দাবি, চাপ আসছে সরকারি মহল থেকেও।
|