খাস কলকাতা শহরের বুকে এক নাবালিকাকে বন্দি রেখে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগ দায়ের হয়েছে তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে। যৌন নির্যাতন ছাড়াও তাঁদের বিরুদ্ধে দাখিল হয়েছে মেয়েটিকে জবরদস্তি আটকে রাখা, মারধর করা, ভীতি প্রদর্শন ও শিশু নিগ্রহের অভিযোগ।
সঙ্গে জড়িয়েছে কিছু পুলিশকর্মীর নামও। পুলিশেরই কাছে দায়ের করা লিখিত অভিযোগে মেয়েটি নিজেই জানিয়েছে, ওই তিন আইনজীবী ছাড়াও শহরের বেশ ক’জন পুলিশ অফিসার তাঁর উপরে অত্যাচারে সামিল হয়েছিলেন। ওই পুলিশ অফিসারেরাও তাঁকে যৌন নিগ্রহ করতেন বলে মেয়েটির অভিযোগ। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, পুলিশ ছাড়াও অন্য অনেক পেশার লোকজনকে তার কাছে আনার কথা অভিযোগে উল্লেখ করেছে কিশোরী মেয়েটি।
গত রবিবার কলকাতার শিশুকল্যাণ সমিতির নির্দেশে এই অভিযোগ দায়ের হয়েছে ফুলবাগান থানায়।
যদিও সোমবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্তেরা এখনও গ্রেফতার না-হওয়ায় এ দিন শিয়ালদহ কোর্টের বিচারক অরুণ রাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি কিশোরীর অভিযোগ নিয়ে এ দিন তোলপাড় হয়েছে মহানগরের পুলিশমহল। লালবাজারের এক পদস্থ কর্তা জানান, পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের কানেও বিষয়টি পৌঁছেছে। ঘটনার সঙ্গে কোনও পুলিশ অফিসার সত্যিই যুক্ত কিনা, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন সিপি। এই অভিযোগ সম্পর্কে কলকাতা পুলিশের ‘সরকারি বয়ান’ কী?
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ এ দিন বলেন, “রবিবার ফুলবাগান থানায় ওই কিশোরী একটি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেছে। তার অভিযোগে তিন আইনজীবীর কথা
বলা হয়েছে। ফুলবাগান থানা তদন্ত শুরু করেছে।” নালিশ দাখিলের পরে চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেলেও কেউ গ্রেফতার হল না কেন, সে প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা-প্রধান বলেন, “তদন্ত চলছে। উপযুক্ত প্রমাণ মিললেই গ্রেফতার করা হবে।” লালবাজারের-সূত্রের খবর, মেয়েটি যে ‘মধুচক্রের’ শিকার, প্রাথমিক তদন্তে তেমন একটা ইঙ্গিত মিলেছে। যদিও অভিযোগকারিণীর বক্তব্যে কিছু অসঙ্গতিও আছে বলে তদন্তকারীদের একাংশের দাবি। “বিস্তারিত তদন্তে সব পরিষ্কার হবে।” এ দিন বলেন কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা।
ঘটনার সূত্রপাত বছরখানেক আগে। কিশোরীটির অভিযোগের বয়ান অনুযায়ী, তার বাড়ি রাজারহাটে, থাকত মা ও সৎবাবার সঙ্গে। পারিবারিক অশান্তির জেরে সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। তার পরে, ২০১২-র ১৩ সেপ্টেম্বর মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় নামে এক বন্ধু তাকে কাঁকুড়গাছিতে এক মহিলার বাড়িতে এনে তোলে, যিনি শিয়ালদহ আদালতের আইনজীবী। ১৪ সেপ্টেম্বর ওই মহিলা তাকে তার রাজারহাটের বাড়িতে নিয়ে যান। মেয়েটির অভিযোগ: বাড়ির লোক ওই মহিলার সঙ্গে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেন, ওঁর বাড়িতে কাজ করার জন্য। এবং নাবালিকা মেয়েটি যে তাঁর বাড়িতে স্বেচ্ছায় কাজ করছে, ওই আইনজীবী সেটা তাকে দিয়ে লিখিয়েও নেন বলে অভিযোগ।
পুলিশের কাছে কিশোরীটি লিখিত ভাবে জানিয়েছে, কাঁকুড়গাছির বাড়িতে থাকাকালীন ওই মহিলা আইনজীবী, তাঁর স্বামী এবং আরও এক আইনজীবী তাকে দিয়ে প্রতি দিন ম্যাসাজ করাতেন। এ ছাড়া কিছু পুলিশ অফিসার-সহ নানা পেশার পুরুষ ওই বাড়িতে তার সঙ্গে ‘সময় কাটাতেন’ বলে অভিযোগ। তাঁদের মধ্যেই মিলন ও শৈলেন নামে দু’জন নিজেদের পুলিশ হিসেবে তার কাছে পরিচয় দিয়েছিলেন বলে মেয়েটি অভিযোগে জানিয়েছে। এ-ও জানিয়েছে, তাকে পুরীর একটি হোটেলে নিয়ে গিয়েও যৌন নিগ্রহ করা হয়েছিল। পুলিশ-সূত্রের খবর: নাবালিকাটির দাবি, যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদ করলে ওই মহিলা আইনজীবী ও তাঁর সঙ্গীরা পুলিশের বড়কর্তাদের সঙ্গে নিজেদের ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথা জানিয়ে তাকে হুমকি দিতেন।
এমনকী, ওই মহিলা আইনজীবী কলকাতা পুলিশের এক ডেপুটি কমিশনারের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবেও নিজেকে জাহির করতেন বলে মেয়েটি পুলিশকে জানিয়েছে।
সে ওখান থেকে বেরোল কী ভাবে?
তদন্তকারী-সূত্রের খবর: মেয়েটি পুলিশকে জানিয়েছে, দিনের পর দিন যৌন অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে এক বার সে কাঁকুড়গাছির বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তবে ধরা পড়ে যায়। দিন কয়েক আগে ফের পালায়। তখনই পুলিশ তাকে উদ্ধার করে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে পাঠায়। ওই সংস্থাটি তাকে নিয়ে যায় কলকাতার শিশুকল্যাণ সমিতির কাছে। পুলিশ জানিয়েছে, মেয়েটির তরফে শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারী পুলিশকে বিষয়টি জানান। তার পরে তদন্ত শুরু হয়।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, ২০১২ সালে মেয়েটি নিজের বাড়ি থেকে পালানোর পরে তার পরিবার স্থানীয় থানায় মিসিং ডায়েরি করেছিল। পরে ওই মহিলা আইনজীবী যখন তাকে রাজারহাটের বাড়িতে নিয়ে যান, তখন মেয়েটির সৎবাবা ও মা তাকে ফেরত নেননি। তাই তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পুলিশকর্তাদের একাংশের মতে, মা ও সৎবাবা টাকার লোভেও মেয়েটিকে ওই মহিলার হাতে তুলে দিয়ে থাকতে পারেন। |