বিশ্ব-বিপণনের বাজারে কুমোরটুলির গরুর গাড়ি
কুমোরটুলির উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল। মৃত্‌শিল্পীদের থাকা এবং প্রতিমা গড়ার জন্য স্থায়ী ঘরবাড়ির জায়গাও প্রস্তুত ছিল। তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ‘সদিচ্ছা’র অভাবে আজও হয়ে উঠল না কুমোরটুলি-প্রকল্প।
মাটির প্রতিমা নির্মাণে বিশ্বে সমাদৃত হলেও কুমোরটুলি এখনও উত্তর কলকাতার কানা গলিতেই সীমাবদ্ধ। ছোট-ছোট গলির ভিতরে দমবন্ধ করা পরিবেশেই বছরের পর বছর প্রতিমা গড়ছেন শিল্পীরা। এক শিল্পীর কথায়, “কী আর করব বলুন? প্রতিমা গড়া আমাদের কাজ। সেটাই করে যাচ্ছি। যাঁরা এলাকার উন্নয়ন করবেন, তাঁরা যদি সক্রিয় না হন, তা হলে এ ভাবেই কাটাতে হবে।” অথচ, এঁদের তৈরি প্রতিমা নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিচ্ছে ফি-বছর।
রাজ্য সরকার কি কুমোরটুলির এই দশা জানে না?
“আলবাত জানে,” দাবি করলেন শিল্পী মৃন্ময় পাল। তাঁর কথায়, “বাম আমলে ঘটা করে এক বার কাজ শুরুও হয়েছিল। তার পরে আবার সব কিছু চুপচাপ হয়ে গেল। কেন, তা জানি না।” তিনিই জানান, কেএমডিএ-র উদ্যোগে কাজটি হচ্ছিল।
জলে-কাদায় মাখা পথ। তার মধ্যেই কাজ শিল্পীদের।
সাবেক কুমোরটুলির হাল বদলায়নি এতটুকুও। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
স্থানীয় বাসিন্দা তথা প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ সুধাংশু শীল জানান, প্রায় সাড়ে আটশো পরিবার বাস করে ওই অঞ্চলে। তার মধ্যে ২৫০ পরিবার মৃত্‌শিল্পী। বাকিরা অন্য পেশায়। ঘুপচি গলি থেকে শিল্পীদের সুস্থ পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে ২০০৫ সালে ৩৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে কেএমডিএ। জেএনএনইউআরএম-এর আর্থিক সহায়তায় ওই প্রকল্প হাতে নেয় রাজ্য সরকার। ঠিক হয়, ৫২৪টি ফ্ল্যাট হবে। সেখানেই পুনর্বাসন দেওয়া হবে ওই এলাকার বাসিন্দাদের।
কেএমডিএ সূত্রের খবর, প্রকল্পের নির্মাণ-কাজ চালু করতে টেন্ডারও হয়। কাজের বরাত পায় একাধিক সংস্থা। তার পরেই স্থানীয় ভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কেএমডিএ-র এক কর্তার বক্তব্য, ঠিকা টেনান্টের জমিতে ওই প্রকল্প গড়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওই জমি হস্তান্তরের সমস্যা হওয়ায় মাঝপথেই কাজ আটকে যায়।
কেএমডিএ-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার (বিএসইউপি) হিমাদ্রি রায় জানান, চারটি পর্যায়ে ওই কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। প্রথমে দু’টি পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছিল। বেশ কিছু পরিবারকে সাময়িক পুনর্বাসন দিয়ে একটি গুদামে রাখার ব্যবস্থা হয়। ওই গুদামের উপরে অস্থায়ী ঘর বানানো হয়েছিল আর নীচে প্রতিমা গড়ার জন্য ওয়ার্কশপ। সে ভাবেই কাজ এগোচ্ছিল।
তার পরেই কুমোরটুলির দু’টি গোষ্ঠীর বিবাদে প্রকল্পের কাজে বাধা আসে বলে কেএমডিএ সূত্রের খবর। পরিবর্তনের পরে ওই কাজ ফের চালুর চেষ্টা করে কেএমডিএ। কলকাতার মেয়র তথা কেএমডিএ-র ভাইস চেয়ারম্যান শোভন চট্টোপাধ্যায়কে বিষয়টি জানানোও হয়। শোভনবাবু বলেন, “সুধাংশুবাবুদের আমলে ওই কাজ নিয়ে অনেক জটিলতা হয়েছে। তাই কাজ বন্ধ রয়েছে।” যদিও সুধাংশুবাবুর বক্তব্য, “শোভনবাবুরা উন্নয়ন চান না। তাই কাজ বন্ধ হয়েই পড়ে আছে। ওঁদের কোনও হেলদোল নেই।” আর এক প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই এলাকার উন্নয়ন নিয়ে সুধাংশু শীলেরা অনেক ভাঁওতা দিয়েছেন।
মৃত্‌শিল্পীদের অস্থায়ী বাসস্থান ও মূর্তি গড়ার জায়গা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
ওঁদের আমলেই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। করতে পারেননি।” সুব্রতবাবুর পরেই কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি অবশ্য মনে করেন, নোংরা রাজনীতির কারণেই কুমোরটুলির উন্নয়ন বন্ধ হয়ে রয়েছে। তাঁর কথায়, “একটি রাস্তা করতে গেলে হয়তো পাঁচটি গুমটি সরানো প্রয়োজন। কিন্তু ওই গুমটি মালিকদের মদত দিতেও রাজনৈতিক দাদারা দাঁড়িয়ে পড়ে।” কুমোরটুলির ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। যদিও সব রাজনৈতিক দলই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
অন্য দিকে, সিএমডিএ-র একাধিক অফিসারের কথায়, এলাকার একটি গোষ্ঠী ঠিকা টেনান্ট বসিয়ে অনেক অর্থ কামান। ওই জায়গায় নতুন ফ্ল্যাট হলে তাদের স্বার্থে আঘাত পড়বে। বাধা আসছে সেখান থেকেই। অবিলম্বে জমি সরকারের নামে না হলে ওই প্রকল্প গড়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন ওই অফিসারেরা। কিন্তু সেই কাজে উদ্যোগ নেই বলেই সমস্যা হচ্ছে।
কী ভাবছেন কুমোরটুলির শিল্পীরা? কুমোরটুলির ভিতরে সরু গলিগুলি এ বারও বর্ষায় কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে। ওই সরু গলির দু’দিকেই ছোট-ছোট খুপড়ি ঘরে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। বর্ষায় যেন মূর্তি না ভেজে, তাই এ বারও অন্যান্য বারের মতো পলিথিন টাঙানো হয়েছে। শিল্পীরা জানালেন, পলিথিন টাঙিয়েও সমস্যা মিটছে না। ঘরের চাল ফুটো হয়ে বর্ষার জল পড়ছে। তাই প্রতিবারের মতো এ বারও পলিথিন দিয়ে ঠাকুর মুড়ে রাখা হচ্ছে। কথা বলতে বলতে শিল্পীদের চোখে মুখে হতাশা ফুটে ওঠে। আরও একটি বছর যে চলে গেল!‘কুমোরটুলি মৃত্‌শিল্পী সংস্কৃতি সমিতি’র সম্পাদক বাবু পাল বলেন, “পুজোর ৩-৪ মাস আগে থেকেই মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ৪০০ শিল্পীর অধীনে ২৪০০ জনের মতো মজুর কাজ করেন। ২৩০০ থেকে ২৪০০ প্রতিমা তৈরি হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই এত বিশাল সংখ্যক প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে।” তিনি জানান, গত বছর আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া-সহ বেশ কয়েকটি দেশে ৪৩টি দুর্গা প্রতিমা কুমোরটুলি থেকে পাড়ি দিয়েছিল। এ বছর ইতিমধ্যেই ২৭টি দুর্গা প্রতিমা বিশ্বের নানা দেশে পাড়ি দিয়েছে। আরও কয়েকটি যাবে। একই সঙ্গে শহরের বড় বড় ক্লাবের দুর্গা প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে জোর কদমে। এত সবের মধ্যেও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুমোরটুলি পড়ে আছে সেই কানা গলিতেই।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.