যৌন নিগ্রহ আর অত্যাচারের ছবি সে তুলে ধরেছে তার চিঠির ছত্রে ছত্রে।
যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আশ্রয়ে এখন সে রয়েছে, তার এক আধিকারিককে গত সোমবার চিঠিটা লিখেছে নির্যাতিতা কিশোরীটি। সব কথা গুছিয়ে লিখতে পারেনি। সব সময় খুঁজে পায়নি সঠিক শব্দ। লজ্জায় হয়তো বলতেও পারেনি সব কথা। কিন্তু যেটুকু লিখেছে, তা থেকেই স্পষ্ট গত জানুয়ারি থেকে কী অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে তার দিন কেটেছিল আইনজীবী লাভলি চাড্ডার বাড়িতে।
কিশোরীটির এর আগের জীবনও কম করুণ নয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং শিশুকল্যাণ সমিতির কর্তাদের সে বলেছে, ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পরে তার মা আবার বিয়ে করে। সৎ বাবা তার উপর অত্যাচার করতো। তখন দিদিমা তাকে নিয়ে আসেন। রাজারহাটে মাসি-মেসোর সঙ্গে থাকত তারা। দিদিমা মারা গিয়েছেন আজ বছর তিনেক। তার পর ফের অত্যাচার। অতিষ্ঠ হয়ে গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর সে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসে সল্টলেকের সিটি সেন্টারে, আত্মহত্যা করতে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক অনসূয়া গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে কিশোরীটি বলেছে, সিটি সেন্টারেই তার সঙ্গে রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় নামে এক জন যুবকের পরিচয় হয়েছিল। সে তাকে লাভলি চাড্ডার কাছে নিয়ে যায়। সে দিন লাভলি তাকে রাজারহাটের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসেন। মাসি-মেসো ঘাড় থেকে বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলেন। ফলে ঠিক হয়, নতুন বছর থেকে সে লাভলির বাড়িতে থেকে কাজ করবে।
কিশোরীটি যে স্বেচ্ছায় তার কাছে থাকছে, সে কথা তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন লাভলি। সেই সঙ্গে নিয়ে আসতে বলেছিলেন তার ভাগের গয়নাগাটি, সম্পত্তির দলিল ও জন্মের প্রমাণপত্র। কিশোরীটির কথায়, “তখন আমি ওনার প্রতি যেন অন্ধ ছিলাম।”
এই ধারণা কাটতে অবশ্য বেশি দিন লাগেনি। কিশোরীটি লিখেছে, “জানুয়ারি মাসে আমাকে নিয়ে আসে ওনার বাড়িতে। তার পর দেখলাম ল্যান্ড ফোনের তার কেটে দিয়ে দিল। বলল আশেপাশে সবলোক বাজে কারুর সঙ্গে কথা বলা চলবে না।... আমার ফোন কেড়ে নিয়ে নিলো। (রাম) কৃষ্ণকেও আলাদা করে দিল।”
কিশোরীটির অভিযোগ, তার সঙ্গে অশালীন আচরণের সূত্রপাতও তখন থেকেই। “তারপর দিন ওনাদের আসল রূপ দেখতে পেলাম। ওনারা মানে লাভলি যে অ্যাডভোকেট সে তো আমার সঙ্গে রাফলি ব্যবহার করতে লাগলেন। আমার সামনে লাভলি চাড্ডার স্বামি (যাঁর নাম সুব্রত মিশ্র এবং লাভলির সঙ্গী বলে জানা গিয়েছে) ......(অন্তর্বাস) পরে ঘুরতে লাগলেন।” এর পর লাভলি অশালীন ভাবে তাকে ম্যাসাজ করার নির্দেশ দিত জানিয়ে কিশোরীটি অনসূয়াদেবীকে লিখেছে, “আন্টি আমার কাছে যে কী লজ্জার ব্যাপার আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি এমন নোংরা যায়গা আগে কখনও দেখিনি।”
তার উপর যৌন নিগ্রহ শুধু লাভলি আর তাঁর স্বামীতেই থেমে থাকত না জানিয়ে কিশোরীটি আরও এক আইনজীবী এবং এক পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। সে লিখেছে, “ওনাদের বাড়িতে একটা পুলিশ আসত, যার নাম ছিল মিলন। উনি এসে আমার গায়ে হাত দিত, উল্টোপাল্টা জায়গায় হাত দিত। দিদিকে বললে বলতো এ সব কমন ব্যাপার।” এ ছাড়া, সব্যসাচী রায়চৌধুরী নামে এক আইনজীবীও লাভলি চাড্ডার বাড়িতে প্রতিদিন আসতেন বলে কিশোরীটি জানিয়েছে। তিনি নিজেকে সিআইডি অফিসার বলেও পরিচয় দিতেন। এই সব্যসাচী যে শুধু তাকে যৌন নির্যাতন করতেন তা-ই নয়, যৌন সংসর্গ করানোর জন্য এক পুলিশ অফিসারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও কিশোরীটির অভিযোগ। সে লিখেছে, “আমি ওনাকে কত রিকোয়েস্ট করি এবং পা ধরে অনেক কাঁদি। কিন্তু তারা আমার কথা কেউ শোনেনি। আমি সে রাতে হাত কামড়ে পালাই এবং অন্যরা ধরে গাড়িতে তোলেন। আর আমাকে অন্ধকার একটা ঘরে আটকে রাখেন প্রায় এক মাস।”
এর পর ফের তাকে লাভলির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সব্যসাচী জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে এবং ২৬ জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে জোর করে যৌন সংসর্গ করাতে বাধ্য করবে বলে হুমকি দেয় বলে কিশোরীটির অভিযোগ।
সে জানিয়েছে, লাভলির বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় মদের আসর বসত। সেখানে তাকে মদ খাওয়ার জন্য জোর করা হতো। পুরীতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েও তার উপর যৌন অত্যাচার করা হয়েছে।
কিশোরীটি তার অভিযোগপত্রে জানিয়েছে, অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে লাভলির প্রাক্তন গাড়িচালকের সঙ্গে তার কাকার বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে লাভলিরা তাকে ধরে আনেন এবং মারধর করেন। বাড়ে যৌন নির্যাতনের মাত্রা। রামকৃষ্ণর সঙ্গে যোগাযোগ করায় লাভলিরা তার নামেও ‘পাঁচ, ছটা কেস চাপিয়ে দেয়’ বলে কিশোরীটির অভিযোগ।
লাভলি চাড্ডার সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ না করা গেলেও আইনজীবী সব্যসাচী রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, তিনি ওই কিশোরীটিকে চিনতেন। এ দিন ফোনে সব্যসাচীবাবু বলেন, “লাভলি জুনিয়র অ্যাডভোকেট। কাজের সূত্রে ওই বাড়িতে যাতায়াতের ফলে মেয়েটিকে চিনতাম। সে আমাকে দাদাভাই বলে ডাকত।” মেয়েটিকে তিনি-ই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছেন দাবি করে সব্যসাচীবাবু এ দিন বলেন, “যদি মেয়েটির ক্ষতিই চাইব, তা হলে কেন ওকে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে তুলে দেব?”
এক জন নাবালিকার উপরে এই অত্যাচারের কথা, তা-ও আইনজীবী এবং পুলিশের হাতে, শুনে বিস্মিত হয়ে যান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিকেরা। তাঁরা চিঠিটি অবিলম্বে পাঠিয়ে দেন শিশুকল্যাণ সমিতির কাছে। সমিতিই বিষয়টি পাঠায় পুলিশে। ওই চিঠিটাই এখন তদন্তকারীদের প্রধান অস্ত্র বলে জানিয়েছেন লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা। তাঁর বক্তব্য, চিঠিটির যে সব জায়গায় অস্বচ্ছতা রয়েছে, সে সব জায়গাগুলি স্পষ্ট করার জন্য কিশোরীটির সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।
অত্যাচার, নিগ্রহ, হুমকির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে অবশেষে নিজের কথা বলতে পেরেছে সে। এ বার বিচার চায় নির্যাতিতা নাবালিকা। নিজের হাতে শাস্তি দিতে চায় অত্যাচারীদের। |