|
|
|
|
শিল্পীর স্বপ্নপূরণে বাধা দারিদ্র
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
লালগড় থেকে শান্তিনিকেতন, দূরত্বের হিসেবে পথটা তেমন বেশি নয়। তবে, এই দূরত্ব পেরনো নিয়েই সংশয়ে লালগড়ের যুবক অপরেশ পাল।
ছোট থেকেই আঁকার ঝোঁক বৈতা এলাকার যশপুর গ্রামের এই যুবকের। সময় পেলেই খাতা-পেনসিল নিয়ে বসে পড়ত সে। সাদা পাতায় চলত আঁকিবুকি কাটা। তবে প্রত্যন্ত গ্রামে প্রথাগত শেখার সুযোগ সে ভাবে মেলেনি। তা সত্ত্বেও শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন বুনে গিয়েছেন অপরেশ। সম্প্রতি বিশ্বভারতীতে ফাইন-আর্টস নিয়ে পড়ার সুযোগও মিলেছে। কিন্তু স্বপ্নপূরণে বাধা অর্থাভাব। বাবা-মা জানিয়ে দিয়েছেন, দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই। অপরেশের কথায়, “বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বিঘে দুয়েক জমি রয়েছে। সেটা চাষ করে সংসার চলে। নিজে টিউশন করে কলেজে পড়ার খরচ চালিয়েছি। কিন্তু শান্তিনিকেতনে পড়তে পারব কিনা জানি না!”
বিশ্বভারতীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় মেধা তালিকার দু’নম্বরে নাম রয়েছে লালগড়ের এই তরুণের। অর্থাৎ কলাভবনে
|
অপরেশ পাল।
—নিজস্ব চিত্র। |
প্রবেশের ছাড়পত্র তাঁর হাতে। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষাতেও মেধা তালিকার দু’নম্বরে তাঁর নাম রয়েছে অপরেশের। কিন্তু অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারেননি। অপরেশের কথায়, “আর্ট কলেজে ভর্তির দিন পেরিয়েছে। শান্তিনিকেতনে ভর্তির শেষ দিন ৬ অগস্ট। জানি না কী হবে!”
গত বছর বিবেক ছাত্র-যুব উৎসবে লালগড় ব্লকে অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন অপরেশ। ঝাড়গ্রামে আয়োজিত রাজ্য চারুকলা পর্ষদের কর্মশালাতেও যোগ দিয়েছেন। একের পর এক স্বীকৃতি মিললেও অপরেশের চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নপূরণের বাধা কিন্তু সেই দারিদ্র্য। বাবা প্রীতীশ পাল চাষবাস করেন। মা সবিতাদেবী গৃহবধূ। দুই ছেলের মধ্যে অপরেশ ছোট। দাদা অনিমেষ চাষের কাজে বাবাকে সাহায্য করেন। চাকরি জোটেনি। অপরেশের প্রাথমিকের পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই পরে ভর্তি হন ঝাড়গ্রামের সেবায়তন হাইস্কুলে। ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর খড়্গপুর কলেজ। লালগড়ে যে কলেজ নেই! ইতিমধ্যে অপরেশের পরিচয় হয় চিত্রশিল্পী ধীমান পালের সঙ্গে। সেটা বছর ছয়েক আগের কথা। অপরেশ বলছিলেন, “ওঁর নাম শুনেছিলাম। একদিন খড়্গপুরে গিয়ে দেখা করি। উনি এককথায় আমাকে আঁকা শেখাতে রাজি হয়ে যান।” ধীমানবাবু খড়্গপুর অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আটর্সের সম্পাদক। রেলশহরের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। বছর দুয়েক আগে রবীন্দ্র চারুকলা পরিষদ থেকে রবীন্দ্র পুরস্কারও পেয়েছেন।
ধীমানবাবুর কথায়, “ও খুব ভাল আঁকে। ওর মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। আরও বড় হবে।” আগে সপ্তাহে এক- দু’দিন খড়্গপুরে এসে আঁকা শিখতেন অপরেশ। বাড়ি থেকে যাতায়াত করতেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শহরে থাকতে শুরু করেন। ধীমানবাবু তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দেন। লালগড়ের এই প্রতিভাবান শিল্পীর কথায়, “ওঁর সহযোগিতা ভোলার নয়। উনি পাশে না থাকলে হয়তো এ ভাবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষাগুলো দিতে পারতাম না।”
লালগড়ে অশান্তি-পর্বে সমস্যায় পড়তে হয়েছে অপরেশকেও। তাঁর কথায়, “অনেক রকম সমস্যাই হয়েছিল। একদিন খড়্গপুরে আসার জন্য গ্রাম থেকে বেরোচ্ছিলাম। এক জওয়ান পথ আটকালেন। জানতে চাইলেন, কোথায় যাব, বাড়ি কোথায়, ব্যাগে কী আছে, আরও কত কী। ব্যাগ থেকে হাতে আঁকা কয়েকটা ছবি বের করে দেখানোর পর অবশ্য জওয়ান পথটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমন সমস্যার মধ্যে সকলকেই পড়তে হত।” প্রকৃতির ছবি আঁকতে ভালবাসেন অপরেশ। গাছপালা, পুকুর, খালবিল, মোরাম রাস্তা, খড়ের বাড়ি অপরেশের ছবিতে ফিরে ফিরে আসে এই বিষয়গুলি। তাঁর কথায়, “গ্রামের পরিবেশটা একেবারে আলাদা। শহরের মতো এতো ঘিঞ্জি নয়। চারপাশে কত গাছপালা। আমি গ্রামের ছেলে। প্রকৃতির ছবি আঁকতেই ভাল লাগে।”
এই ভাললাগায় যাতে দাঁড়ি না পড়ে, কলাভবনে আঁকা শেখার সুযোগ যাতে মেলে, সে জন্য আপাতত সহৃদয় কোনও ব্যক্তির সাহায্যের প্রতীক্ষায় লালগড়ের এই তরুণ। |
|
|
|
|
|