প্রবন্ধ ২...
আদালতে কত মামলা চলছে, সেটাই সব নয়
কোন জিনিসের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য? আমি বলব, আইনশৃঙ্খলা। বাকি সব তার পর। সরকার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখবে, এই আশাতেই তো মানুষ ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করে।
দেশের আইনি ব্যবস্থারও সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের তিনটে স্তর রয়েছে। প্রথম স্তর হল বিধিবদ্ধ আইনের সংস্কার। এর তিনটে দিক রয়েছে: মান্ধাতার আমলের, অচল যে সব আইন রয়েছে, সেগুলোকে ছেঁটে ফেলা; একই ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনের মধ্যে সমতা বিধান এবং সেগুলিকে একই আইনের মধ্যে নিয়ে আসা; এবং, অপ্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অবকাশ কমিয়ে আনা। সংস্কারের দ্বিতীয় স্তর হল প্রশাসনিক আইনের সংস্কার: বিভিন্ন মন্ত্রকের এবং সরকারি দফতরের যে হরেক নীতি, নির্দেশ, বিধি ইত্যাদি আছে, সেগুলির সংস্কার। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কাজের সিদ্ধান্ত আটকে গিয়েছে এই প্রশাসনিক আইনের জটে আটকে যায়। এবং, সেই জটেই ঘুষ চাওয়ার প্রবণতার জন্ম। সংস্কারের তৃতীয় এবং শেষ স্তর হল বিচারবিভাগীয় সংস্কার। তবে এই কথাটা মাথায় রাখা প্রয়োজন যে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে কি না, কোনও চুক্তি যথাযথ ভাবে লাগু করা যাচ্ছে কি না, এগুলো শুধুমাত্র বিচারবিভাগীয় প্রশ্ন নয়।
ভারতের আইনি ব্যবস্থার কাঠামো যাঁদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়, তাঁদের জন্য কিছু প্রাথমিক তথ্য দিয়ে রাখি। গোটা দেশে প্রায় ১২,০০০ আদালত রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট একটি, মোট ২১টি হাইকোর্ট, ৩১৫০টি জেলা আদালত, ৪৮১৬টি মুন্সেফ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এবং ১৯৬৪টি দ্বিতীয় ম্যাজিস্ট্রেট বা সমতুল্য আদালত। কিছু হাইকোর্টের ‘অরিজিনাল জুরিসডিকশন’ বা আদি অধিক্ষেত্র রয়েছে— দেওয়ানি মামলার আর্থিক মূল্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হলে মামলাটি সরাসরি সেই হাইকোর্টে দায়ের করা যায়। অন্য হাইকোর্টগুলি অ্যাপিলেট কোর্ট। যে সব রাজ্যের হাইকোর্টের আদি অধিক্ষেত্র নেই, সেখানে বিপুল অর্থ সংক্রান্ত মামলাও প্রথমে নিম্ন আদালতে দাখিল করতে হয়। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, সেই মামলার নিষ্পত্তি করার মতো দক্ষতা নিম্ন আদালতের নেই। এই জাতীয় মামলা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবেই হাইকোর্টে পৌঁছোয়, খালি কিছুটা সময় নষ্ট করার পর। আবার, যে সব হাইকোর্টের আদি অধিক্ষেত্র রয়েছে, সেখানে মামলার ন্যূনতম আর্থিক মূল্য এতই কম ধার্য করা থাকে যে বহু অবান্তর মামলাও সরাসরি হাইকোর্টে পৌঁছে যায়। নির্দিষ্ট সংবিধি (স্ট্যাটিউট) অনুসারে সব হাইকোর্টেরই অতিরিক্ত আদি অধিক্ষেত্র থাকে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার একই আদালতে চলে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কিছু আইন-অতিরিক্ত কারণে ফৌজদারি মামলা অগ্রাধিকার পায়। ফলে, দেওয়ানি মামলা চালানোর খরচ বেড়ে যায়। অন্য সমস্যাও আছে। জেলাশাসকদের ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা এবং সাধারণ প্রশাসনিক বিষয়গুলি দেখাশোনা করতে হয়। আবার, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে তাঁরাই অ্যাপিলেট অধিকর্তা। কোনটি প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর কোনটি বিচারবিভাগীয়, সেই বিভাজন আদৌ স্পষ্ট নয়। এর পাশাপাশি রয়েছে ট্রাইবুনাল এবং বিভিন্ন আধা-বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে সাংবিধানিক প্রশ্নের নিষ্পত্তি করার অধিকার নিম্ন আদালতগুলির নেই।
বিচারবিভাগীয় সংস্কারের অন্তত চারটি দিক রয়েছে। এক, বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এবং, একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বিচারক নন কিন্তু বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, এমন কর্মীদের সংখ্যা ও দক্ষতা বৃদ্ধিও অতি প্রয়োজনীয়। জোগান বৃদ্ধির মাধ্যমে বিচারবিভাগের সংস্কারের পথ হিসেবে বিচারকের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রসঙ্গটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এই কথাটি বেঠিক নয়, কিন্তু অসম্পূর্ণ। বিচারকের শূন্য পদ পূরণ করার ক্ষেত্রে, অথবা তাঁদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক গড়িমসিও একটা বড় সমস্যা।
সংস্কারের দ্বিতীয় দিকটি হল বিচারবিভাগের কুশলতা বৃদ্ধি, আদালতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সক্রিয় হওয়া। এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারবিভাগীয় কর্মীরা যাতে দক্ষতা অর্জন করেন, কুশলী ভাবে প্রশাসনিক কাজ সামলাতে পারেন, তারও ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকাঠামোর উন্নতিসাধন করতে হবে, এবং সেই উন্নতির ফলকে কাজে লাগিয়ে মামলার প্রক্রিয়াটিকে গতিশীল করতে হবে।
সংস্কারের তৃতীয় দিকটি দ্বিতীয় সংস্কারেরই প্রসারিত রূপ। আদালতের কাজে কুশলতা বৃদ্ধি করতে তথ্যপ্রযুক্তি ও দূরসংযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। চতুর্থ কর্তব্য হল, মধ্যস্থতা, আপস-মীমাংসা, সালিশি ইত্যাদির মাধ্যমে বিবাদ নিরসনের পথ খোঁজা, যাতে আদালতে যাওয়ার প্রবণতা কমে। দেওয়ানি মামলায় সরকারের উপস্থিতিও কমানো চাই।
বিচারব্যবস্থার বিলম্ব সম্বন্ধে চারটে ইংরেজি শব্দ নিয়মিত ব্যবহৃত হয়— পেনড্যান্সি, অ্যরিয়ার, ডিলে এবং ব্যাকলগ। শব্দগুলিকে সমার্থক হিসেবেই ব্যবহার করতে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু চারটি শব্দের পৃথক পৃথক অর্থ রয়েছে। পেনড্যান্সি অর্থ হল আদালতে মোট দায়ের হওয়া মামলা। বস্তুত, পেনড্যান্সি বেশি হওয়া সুলক্ষণ, তাতে বোঝা যায় আদালতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে। অ্যরিয়ার মানে যত নতুন মামলা আদালতে দায়ের করা হচ্ছে, এবং যত মামলার ফয়সলা হচ্ছে, তার ব্যবধান। অ্যরিয়ার থেকেই ডিলে-র সৃষ্টি হয়। ডিলে বলতে বোঝায়, যে মামলাগুলির এখনও ফয়সলা হয়নি। ব্যাকলগ শব্দটি কখনও ব্যবহৃত হয় পেনড্যান্সি বোঝাতে, কখনও ডিলে বোঝাতে। যে ভাবে শব্দগুলি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে চলেছে, তাতে আমার মনে হয় এ বার একটা নতুন শব্দবন্ধের দিকে যাওয়া যেতে পারে: জুডিশিয়াল কনজেশন বা বিচারবিভাগীয় জট। এই শব্দটা ব্যবহার করলে তা আন্তর্জাতিক পরিভাষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও হবে।
ভারতের আদালতগুলিতে এই মুহূর্তে মোট কত মামলা আছে? প্রায় তিন কোটি। তার মধ্যে ৬০,০০০ মামলা সুপ্রিম কোর্টে, ৩৭ লক্ষ মামলা বিভিন্ন হাইকোর্টে, এবং দু’কোটি চুয়ান্ন লক্ষ মামলা নিম্ন আদালতগুলিতে। মনে রাখতে হবে, এটা প্রথমত নিখুঁত হিসেব নয়, এবং দ্বিতীয়ত হিসেবটি কিছু দিন আগের। বিভিন্ন স্তরে বিচারবিভাগীয় জট সম্বন্ধে স্পষ্ট পরিসংখ্যান পেতে অনেক দেরি হয়। কাজেই, কোথাও যদি শোনেন যে ভারতে মোট সাড়ে তিন কোটি মামলা বকেয়া পড়ে আছে, আশ্চর্য হবেন না। ওটা নতুন হিসেব। আমি ইচ্ছে করেই একটু পুরনো হিসেব নিয়ে কাজ করছি, যাতে বিভিন্ন স্তরের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
আমি রাজ্যগুলির দিকে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের দিকে, তাকাতে চাই— ফলে এই আলোচনা থেকে আপাতত সুপ্রিম কোর্টকে বাদ রাখছি। ১৯৮৭ সালে দেশের হাইকোর্টগুলিতে মোট ১৪ লক্ষ ৮০ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এখন সংখ্যাটি ৩৭ লক্ষের কিছু বেশি। ইলাহাবাদ হাইকোর্ট এই ক্ষেত্রে দেশে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। দেশের সব হাইকোর্টে যত মামলা চলছে, তার ২২ শতাংশই চলছে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে। দু’নম্বরে মাদ্রাজ হাইকোর্ট, এখানে ১১.৫ শতাংশ মামলা চলছে। তার পর তালিকায় আছে বম্বে হাইকোর্ট (১০%), কলকাতা হাইকোর্ট (৭.৫%), পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট (৭%), ওড়িশা হাইকোর্ট (৬.২%) এবং রাজস্থান হাইকোর্ট (৫.৭%)। ইলাহাবাদ, মাদ্রাজ, বম্বে, কলকাতা এবং পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে দেশের হাইকোর্টে মোট মামলার ৬০ শতাংশ জমে রয়েছে। এর সঙ্গে রাজস্থান, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং কেরল হাইকোর্ট যোগ করলে এই ন’টি হাইকোর্টেই জমে রয়েছে দেশের মোট ৭১ শতাংশ মামলা।
এই মামলাগুলির মধ্যে দেওয়ানি মামলাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বকেয়া মামলার মধ্যে ফৌজদারি মামলা ১৮-১৯ শতাংশ। কাজেই, হাইকোর্টে মামলা জমে থাকার সমস্যাটি মূলত দেওয়ানি মামলার কারণেই। তবে, হিসাবশাস্ত্রের ভাষায় বললে, পেনড্যান্সি হল ‘স্টক’, মানে যা কোনও একটি সময়বিন্দুতে পরিমাপ করা যায়, আর অ্যরিয়ার হল ‘ফ্লো’, মানে যা একটি সময়পর্ব ধরে হিসেব করতে হয়। দ্বিতীয়টিকে মাপকাঠি ধরলে মামলা বকেয়া থাকার সমস্যাটি আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝা সম্ভব। এই নিরিখে, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত, কেরল, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের হাইকোর্টগুলি মামলা বকেয়া থাকার সমস্যাটি অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট পারেনি। সেখানে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু আপাতত সেই আলোচনা থাক। কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, সে বিষয়ে পরে কথা বলা যাবে।

দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.