প্রবন্ধ ১...
কার পেটে খিদে আর কার হাতে ক্ষমতা
মিড ডে মিল-এ বিষাক্ত খাবার খেয়ে তেইশটা বাচ্চা মরে গেল বলেই দেশের ছ’লাখ চল্লিশ হাজার গ্রামের চেয়ে সারন জেলার মশরখ ব্লকের গন্দামন গ্রাম আলাদা, এমনটা নিশ্চয়ই কেউ ভাবছেন না। সেই গ্রামে আমি যাইনি। সারন জেলায় গিয়েছিলাম, কয়েক বছর আগে। কিন্তু দেখা-না দেখায় কিছু এসে যায় না, সত্যি। যে বাচ্চাগুলো বেবাক মরে গেল, তারা ঠিক কারা, অনুমান করতে পারি। খড়ি ওঠা গা, মাথায় লালচে খয়েরি চুল, হাওয়াই চটি পরে স্কুলে আসা বাচ্চা। হদ্দ গরিব পরিবারের বাচ্চা, ‘নিচু’ জাতেরও। আসলে দেশের বেশির ভাগ বাচ্চাই তাই গরিব, অন্ত্যজ শ্রেণির। এই গ্রামটার সম্বন্ধে সামান্য কিছু পরিসংখ্যান পাওয়া গেল, এবং তাতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য হিসেবেই পিছিয়ে থাকা বিহারের তুলনাতেও এই গ্রামটা পিছিয়ে আছে। যেমন, বিহারে তফশিলি জাতিভুক্ত মানুষ মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, গন্দামনে ২৭ শতাংশ। গ্রামের ৫৮ শতাংশ মানুষ ভূমিহীন কৃষক— গোটা দেশেই এই শ্রেণিটি দারিদ্রের একেবারে তলানিতে থাকে। গ্রামে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৮ শতাংশ, মেয়েদের মধ্যে ১৮ শতাংশ। এই গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চার কাছেই দেশের বেশির ভাগ বাচ্চার মতোই স্কুলের দুপুরের খাওয়া একটা মস্ত পাওনা। মরে যাওয়া তেইশটা বাচ্চার কাছেও নিশ্চয়ই তা-ই ছিল।
কেন খাবারে বিষ মিশে গেল, তা নিয়ে হরেক আলোচনা চলছে। রাজনীতিকরা খেলছেন নরেন্দ্র মোদী সুদূর গুজরাত থেকে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। হাজার হোক, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তো। লালুপ্রসাদ যাদব প্রায় উল্লসিত মুখে শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান পেশ করেছেন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে। বিহারের শিক্ষামন্ত্রী ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। কী করা যাবে, তাঁদের পেশাগত দায় সত্যিটা জানলেও সব সময় বলতে পারেন না। আসল কথাটা নিশ্চয়ই তাঁরাও জানেন এই তেইশটা বাচ্চা নেহাতই হতভাগ্য যে একেবারে মরেই যেতে হল তাদের। দেশের ছ’লাখ চল্লিশ হাজার গ্রামের অনেকগুলোতেই মিড ডে মিল আসলে একটা আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দুর্নীতি আর অবহেলার আগ্নেয়গিরি। ধর্মসতীর স্কুলে যে ভাবে মিড ডে মিল তৈরি হত, যে ভাবে বাচ্চাদের পাতে পৌঁছত, আরও বহু স্কুলেই তা-ই হয়। হয়তো কীটনাশক মেশে না বলে প্রাণে বেঁচে থাকে বাচ্চাগুলো, খবর হয় না।
গন্দামনের মতো হতদরিদ্র গ্রামের বাচ্চাদের জন্য কেন মিড ডে মিল জরুরি, তা নিয়ে অনেক আলোচনা গত দেড় দশকে হয়েছে। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট-এর পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ-এর দুই গবেষক মনীষা গর্গ ও কল্যাণশঙ্কর মণ্ডলের সাম্প্রতিক সমীক্ষার (ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, ২৭ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত) কথা বলি। তাঁদের রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে করা সমীক্ষা থেকে মিড ডে মিলের প্রয়োজনীয়তার শ্রেণিচরিত্র স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে, তফশিলি জনজাতিভুক্ত ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে স্কুলের দিন, অর্থাৎ যে দিন দুপুরে তারা মিড ডে মিল পায়, ক্যালরি ইনটেক-এর পরিমাণ ছুটির দিনের চেয়ে বেশি। তফশিলি জাতিভুক্তদের ক্ষেত্রে স্কুলের দিন আর ছুটির দিনে ক্যালরি ইনটেক প্রায় সমান; আর উঁচু জাতের ছেলেমেয়েরা ছুটির দিনে অনেক বেশি ক্যালরি পায়। পরিবারের আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে মোট জনসংখ্যাকে তিন ভাগে ভাগ করলে নিম্নতম শ্রেণির বাচ্চারা স্কুলের দিন অনেক বেশি ক্যালরির খাবার পায়, মাঝের শ্রেণির বাচ্চারা স্কুল আর ছুটির দিন প্রায় সমান, আর উচ্চতম শ্রেণির বাচ্চারা, যথারীতি, ছুটির দিন বেশি ভাল খেতে পায়। অর্থাৎ, জাত অথবা আর্থিক অবস্থা, যে দিক থেকেই দেখি না কেন, মিড ডে মিল আসলে নিম্নতম শ্রেণির কাছে অতি জরুরি, এবং উচ্চবর্গের কাছে অপ্রয়োজনীয়। বাচ্চাদের যতটা প্রয়োজন, মিড ডে মিলে তার চেয়ে অনেক কম পুষ্টির ব্যবস্থা হয় কিন্তু নিম্নতম শ্রেণির মানুষ বাড়িতে সেটুকু পুষ্টিরও সংস্থান করতে পারেন না।
মিড ডে মিল কাদের প্রয়োজন, আর সেই খাবারের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কাদের হাতে শুধু এটুকু ধরতে পারলেই বোঝা সম্ভব, কেন তা দাঁড়িয়ে রয়েছে অবহেলা আর দুর্নীতির আগ্নেয়গিরির ওপর। বিহার সরকারেরই তৈরি করা মিড ডে মিল নির্দেশিকা দেখছিলাম, অন্ধ্র প্রদেশ সরকারের তৈরি ‘উচিত-অনুচিত’-এর তালিকাও। মশরখ ব্লকের স্কুলে যে অবহেলার কারণে বাচ্চাগুলো মরে গেল, তার সবক’টা স্পষ্ট ভাবে বারণ করে দেওয়া আছে সেখানে। যেমন, খোলা জায়গায় রান্না করা যাবে না; খোলা তেল ব্যবহার করা যাবে না; চাল-ডাল রাখার জন্য পরিষ্কার এবং উপযুক্ত পাত্র ব্যবহার করতেই হবে; বাচ্চাদের খেতে দেওয়ার আগে শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে সেই খাবার খেয়ে দেখতে হবে; এক জন বাচ্চাও কোনও রকম শারীরিক অস্বস্তির কথা বললে তাকে অবহেলা করা চলবে না। এবং, পুরো ব্যবস্থাটি যাতে ঠিক ভাবে চলে, সে দিকে নজর রাখার জন্য রাজ্য, জেলা এবং ব্লক স্তরে কমিটি আছে তার শীর্ষে আছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব।
সরকারের ‘সদিচ্ছা’, অন্তত খাতায়-কলমে যেটুকু চোখে পড়ে, তা নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন নেই। তবে, নিয়ম থেকে যায় ফাইলের নিরাপদ আশ্রয়েই। বাস্তব, বহু ক্ষেত্রেই, অন্য গল্প বলে। বিহারেই যেমন টানা পাঁচ বছর পড়ে থাকার পর ৫০০ কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছে ফেরত চলে গেল টাকাটা এসেছিল মিড ডে মিল রান্নার জায়গায় শেড তৈরি করার জন্য। যে তেলের রান্না খেয়ে বাচ্চাগুলো মারা গেল, তাতে কীটনাশক মিশেছিল। সেই তেল এসেছিল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার স্বামীর দোকান থেকে। অনুমান করা চলে, চাল-ডালও পড়ে থাকত অবহেলায়, ইঁদুর-আরশোলার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে।
এই যে গোটা অ-ব্যবস্থাটি চলছিল এত দিন অন্যত্র এখনও চলছে, রোজ সেটা কিন্তু আড়ালে নয়। প্রকাশ্যে, সবার চোখের সামনে। রোজ সেই অব্যবস্থা, অবহেলা, দুর্নীতি দেখেও কারও প্রতিবাদ করার উপায় থাকছে না। প্রতিবাদ করলেও সেই স্বর চেপে দিতে সময় লাগছে পলকমাত্র। পুরো ব্যবস্থার আসল গোলমালটা এখানেই যাঁদের হাতে মিড ডে মিল চালানোর অধিকার, তাঁরা ক্ষমতায়, প্রতিপত্তিতে, সামাজিক অবস্থানে মিড ডে মিলের ওপর নির্ভর করে থাকা মানুষদের চেয়ে অনেক উঁচুতে, কার্যত গ্রহান্তরের মানুষ।
আজ থেকে দশ বছরেরও বেশি আগে, প্রতীচী ট্রাস্টের প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করার সময় অমর্ত্য সেন জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের স্কুলগুলিতেও ‘নিচু’ জাতের ছাত্ররা বঞ্চনার শিকার। মাস্টারমশাইরা তাদের আলাদা বসান, ‘উঁচু’ জাতের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ঢের কম মন দেন তাদের পড়াশোনার দিকে। দশ বছরে ছবিটা খুব বদলেছে বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। এবং, সংরক্ষণ ইত্যাদির পরেও এখনও শিক্ষকতার পেশায় উচ্চবর্ণের সংখ্যাধিক্যই বাস্তব। এটা সামাজিক অসাম্যের একটা দিক। অমর্ত্য সেন, তাঁর নতুন বইয়ে, মনে করিয়ে দিয়েছেন আরও এক অসাম্যের কথা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মাইনে সেই স্কুলে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের মা-বাপের রোজগারের বেশ কয়েক গুণ। এই আর্থিক ব্যবধানের ফলে শিক্ষক আর অভিভাবকরা আসলে দুটো আলাদা দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে যান কোনও রকম সংযোগহীন দুটো দুনিয়া। ফলে, জাতের নিরিখেই হোক অথবা টাকাপয়সার অঙ্কে, ক্ষমতার উচ্চাবচ সম্পর্কটি প্রকট। তার ফলে, মিড ডে মিল আর ছাত্রদের হকের পাওনা থাকে না সেটা কার্যত শিক্ষকের দয়া হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক এবং ছাত্র (ফলত, তাদের অভিভাবকও) সম্পর্কটি হয়ে দাঁড়ায় দাতা ও গ্রহীতার। ঠিক করে বললে, অনেক ওপরে থাকা দাতা এবং একেবারে নীচের তলায় থাকা গ্রহীতার। সেই দানে অবহেলা থাকা স্বাভাবিক।
সম্পর্কের এই উচ্চাবচতাই প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নেয়। গন্দামনের স্কুলের রাঁধুনি জানিয়েছেন, তেলে খারাপ গন্ধ থাকার কথা শুনে প্রধানশিক্ষিকা নিজে কড়াইয়ে তেল ঢেলেছিলেন। বাচ্চাদের আপত্তির কথাও শোনেননি। নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এমনটা করতেন না। স্কুলের গরিব শিশুদের ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় করেছেন, তার দুটো, এবং পরস্পর সংযুক্ত কারণ— এক, সত্যিই এই শিশুদের ভাল-মন্দে তাঁর কিছু এসে যায় না, এবং দুই, তিনি জানতেন, দয়ার দানের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন করার উপায় এদের মা-বাপের নেই।
সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার থেকে স্কুলের মাস্টারমশাই, বিডিও অফিসের কর্মী থেকে রেশন দোকানের মালিক— কাউকেই কি সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন? পারলেও, সেই প্রশ্নের উত্তর পান কি? দিনের পর দিন মানুষ চোখের সামনে দেখেন, মিড ডে মিলের চাল-ডাল চোরাপথে বাজারে চলে যায়, বাচ্চাদের নিকৃষ্ট মানের খাবার দেওয়া হয়, তা-ও অযত্নে তৈরি করে— তার পরেও মানুষ প্রশ্ন করতে যান না। কেন? কারণ তাঁরা জানেন, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। ওপর তলায় নালিশ যদি করাও যায়, সেই নালিশে কান দেওয়ার সময় কর্তাদের থাকবে না। তাঁরাও উচ্চবর্গের মানুষ, বস্তুত আরও বেশি উচ্চবর্গের— মিড ডে মিলের ওপর যাদের বাচ্চাদের নির্ভর করে থাকতে হয়, সেই মরা গরিবরা তাঁদের কেউ না।
এই বার সেই মোক্ষম প্রশ্ন— তা হলে কী হবে? গরিব বাচ্চাগুলোর পাতে অবহেলার অন্ন পড়বে প্রতি দিন? তা-ই খেয়ে যাবে তারা, মরে যাওয়ার ভয় উপেক্ষা করেই? না কি, আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হবে মিড ডে মিল প্রকল্প?
দুটোর একটাও সমাধান হতে পারে না। অন্য পথ আছে। উচ্চবর্গের মানুষের হাতে ক্ষমতা থাকলে অবহেলাই একমাত্র পরিণতি, তা তো নয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে, চমৎকার চলছে মিড ডে মিল। উচ্চবর্গ নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আর, তাদের সেই দায়িত্বের পথে নিয়ে আসতে পারে গণতন্ত্র— অমর্ত্য সেন যে গণতন্ত্রের কথা বলে চলেছেন সমানে। মিড ডে মিল-কে রাজনীতির— বৃহত্তর রাজনীতির— প্রশ্ন করে তুলতে হবে। এমন ভাবে, যাতে যাদের ঘরের বাচ্চারা এই খাবারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের স্বর স্পষ্ট শোনা যায়। অভিজ্ঞতা বলছে, তাতে পরিস্থিতি বদলায়। সেই রাজনীতিতে আস্থা থাকুক। গণতন্ত্রে আস্থা থাকুক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.