আদালতের নির্দেশে অবশেষে স্থগিতাদেশ উঠিল। পাঠ্যবই বাজারে আসিল। ছাত্রছাত্রীরা তাহা সংগ্রহ করিয়া অবশেষে আপন পাঠেতে মন নিবেশ করিতে পারে— শিক্ষাবর্ষ শুরু হইবার মাস-দুয়েক পরে! উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের এতখানি মূল্যবান সময় নষ্ট হইল কেবলমাত্র পদ্ধতিগত অনিশ্চয়তার কারণে, ইহা অবশ্যই পদ্ধতি এবং পদ্ধতি-কর্তাদের পক্ষে এক বিষম লজ্জার বিষয়। এমনিতেই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের জন্য যত কম সময় নির্ধারণ করা হয়, তাহা জুলুম বই কিছু নহে। তাহার উপর দ্বিগুণ অত্যাচার চলিল এই বৎসর, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সহিত রাজ্য সরকারের মতদ্বৈধের কারণে। আদালতের রায়ে বিষয়টির আপাতত এক প্রকার নিষ্পত্তি হইল ঠিকই, কিন্তু আশা করা যায় যে এই আপাত-সমাধানেই সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ এমন আত্মতুষ্ট হইয়া পড়িবেন না যাহাতে বৃহত্তর সমস্যাটি অবজ্ঞাত হয়।
বৃহত্তর সমস্যাটি আর কিছুই নহে, শিক্ষাপ্রশাসনের পদ্ধতিটি আবার গোড়া হইতে ভাবা। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনের জন্য যদি একটি সংসদ নির্ধারিত থাকেই, তাহা হইলে সেই সংসদের কাজে তো রাজ্য সরকারের সরাসরি জড়িত হওয়া উচিত নহে। হাইকোর্টের বক্তব্যও ঠিক তাহাই। কোন প্রকাশনা সংস্থাকে পাঠ্যবই-এর দায়িত্ব দেওয়া হইবে, এই ধরনের বিষয়গুলি যদি সেই সংসদ নির্ধারণ না করিতে পারে, তাহা হইলে সংসদ আছে কেন, ইহাই প্রাথমিক প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের মৌলিক ব্যবস্থাপনার বিষয়েও যদি রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রককেই প্রত্যক্ষ আসরে নামিতে হয়, তাহা হইলে প্রশাসনের অন্যান্য গুরুতর নীতিনির্ধারণ ও নীতি-প্রয়োগের কাজগুলি সারিবার সময়-ই বা থাকিবে কী ভাবে? অর্থাৎ, বই ছাপিবার দরপত্র স্থির করিয়া প্রকাশনা সংস্থা বাছিবার কাজটি সংসদ থাকিতেও কেন প্রশাসনই করিবে, ইহাই মূল প্রশ্ন।
প্রকাশনা সংস্থা নির্বাচন লইয়া যে জটিলতা হইয়াছিল, সে বিষয়ে নানাবিধ বিরুদ্ধ কথা দুই পক্ষই বলিয়া আসিতেছে। তাহার গোলকধাঁধায় না জড়াইয়াও একটি গোড়ার কথা গোড়াতেই বলা যায়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ যেহেতু রাজ্য সরকার অনুমোদিত একটি সংস্থা, সেই সংসদের কার্যক্রমে যদি সরকার কোনও আপত্তিকর বিষয় পাইয়া থাকে, দুর্নীতি সন্দেহ করিয়া থাকে, তবে সে বিষয়ে পদ্ধতিগত স্পষ্টতার সহিত অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য নয় কী? সে-পদ্ধতি নানা প্রকার হইতে পারে। সংসদের সহিত একত্রে বসিয়া মীমাংসা কিংবা সংসদের সভাপতির সহিত আলোচনা কিংবা সংসদের সভাপতিকে নিয়মানুযায়ী সরাইয়া নূতন সভাপতি মনোনয়ন, সবই সম্ভব। কিন্তু সংসদের অস্তিত্বই সাময়িক ভাবে অগ্রাহ্য করিয়া সব দায়িত্ব সরকার নিজ স্কন্ধে লইতে পারে না। তবে, যে সিদ্ধান্তই হউক, ছাত্রছাত্রীদের যাহাতে ক্ষতি না হয়, তাহা দেখা সংসদ তথা রাজ্য সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ। শোনা গিয়াছিল যে সংসদের ওয়েবসাইটে সব পাঠ্যক্রম ‘আপলোড’ করা আছে, ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধার প্রশ্নই নাই! শুনিয়া বিস্ময় মানিতে হইয়াছিল, কেননা এত গর্বিত ঘোষণার মূল ভিত্তিবাক্যটি ছিল, পশ্চিমবঙ্গের সকল পড়ুয়ার আওতাতেই ইন্টারনেট সুলভ! বাক্যুদ্ধ, নীতিদ্বন্দ্ব, দরপত্র, আদালত, এতগুলি স্তর পার হইয়া তবে যদি পড়ুয়াদের হাতে দুই মাস পর বই আসে, শিক্ষাব্যবস্থাকেই অসীম দুর্ভাগা বলিতে হয়! |