বিহারে মিড ডে মিল বিপর্যয়ের পরে নূতন করিয়া একটি পুরানো কথা শোনা যাইতেছে। কথাটি ইহাই যে, এই প্রকল্প যথেষ্ট নিরাপদে পরিচালনা করা কঠিন, রান্না-করা খাবারের গুণমান নিয়মিত সন্তোষজনক ভাবে যাচাই করা দুঃসাধ্য। বিহারের শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং এমন একটি কথা উচ্চারণ করিয়াছেন, তাঁহার মতে রাজ্যের সত্তর হাজার স্কুলে খাবারের গুণমান যথাযথ ভাবে পরীক্ষা করা কঠিন। এই ধরনের অভিমত হইতে অনেকে সহজেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাইয়া যাইতে পারেন মিড ডে মিল প্রকল্প বাস্তবোচিত নহে, অন্ততপক্ষে রান্না করিয়া খাবারের ব্যবস্থা করা বন্ধ হউক, বরং প্যাকেটের খাবার দেওয়া হউক। রান্না-করা খাবারের বদলে প্যাকেটবন্দি খাবার দিয়া মিড ডে মিল প্রকল্প চালু রাখিবার প্রস্তাব অতীতেও শোনা গিয়াছে, সেই প্রস্তাবের পিছনে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দীর্ঘ ছায়াও স্পষ্ট। সুখের কথা, শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব কার্যকর হয় নাই, শুভবুদ্ধি জয়ী হইয়াছে। রান্না-করা খাবারের গুণমান আরও অনেক উন্নত হওয়া দরকার নিশ্চয়ই, কিন্তু মধ্যাহ্নভোজ হিসাবে প্যাকেটের খাবার কখনওই তাহার বিকল্প হইতে পারে না, বিশেষত দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য, যাহাদের অনেকের কাছে স্কুলের ওই খাবারটিই চব্বিশ ঘণ্টার প্রধান খাদ্য। নানাবিধ বাধাবিপত্তি অতিক্রম করিয়া এই প্রকল্প ক্রমশ প্রসারিত হইয়াছে, তাহার উপকারগুলি এখন অত্যন্ত স্পষ্ট এবং স্বীকৃত। বিহারের ট্র্যাজেডির পরে যাহাতে নোংরা জলের সহিত শিশুটিকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা না হয়, তাহা নিশ্চিত করা জরুরি।
এই ট্র্যাজেডি হইতে বরং বিপরীত শিক্ষাই গ্রহণ করা দরকার। বিহারের ঘটনার পরে স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, তদারকির জন্য যে ধরনের বিধিনিয়ম জারি করা হইয়াছিল, কার্যক্ষেত্রে সেগুলি মান্য করা হয় নাই। বিহারের ওই স্কুলটিকে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই, এই ত্রুটি ভারতের বহু স্কুলেই পরিব্যাপ্ত। স্কুলের সংখ্যা অনেক বলিয়া বা অনেক স্কুল প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত বলিয়া তদারকি করা কঠিন— এই ধারণার মধ্যে একটি মৌলিক ভ্রান্তি রহিয়াছে। এ ক্ষেত্রে উপর হইতে, সদর দফতর হইতে তদারকির কোনও প্রয়োজন নাই, বরং স্থানীয় সমাজের, বিশেষত অভিভাবকদের এবং শিক্ষকদের যথার্থ নজরদারিই কাম্য। যে সব অঞ্চলে সেই স্থানীয় অংশীদারি আছে, সেখানে মিড ডে মিল প্রকল্প ভাল চলিতেছে। ব্যর্থতা হইতে যেমন প্রয়োজনীয় শিক্ষা লওয়া দরকার, সাফল্যের নজির হইতেও তেমনই। সেই কাজে সরকারি কমিটি বা দফতর উৎসাহ দিতে পারে, মূল নিয়ম স্থির করিতে পারে, সামগ্রিক পর্যালোচনা করিতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তদারকি সমাজকেই করিতে হইবে। স্থানীয় স্তরে এই প্রাথমিক নজরদারিই যদি দুঃসাধ্য হয়, তবে ঘটা করিয়া পঞ্চায়েতি রাজ, গ্রামসভা ইত্যাদি আয়োজনের অর্থ কী?
এই সূত্রেই একটি বৃহত্তর প্রশ্ন ওঠে। গণতন্ত্রের প্রশ্ন। এ দেশে গণতন্ত্রের গভীরতা এবং বিকেন্দ্রীকরণ লইয়া অনেক কথা বলা হইয়া থাকে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষত নির্বাচনী রাজনীতির প্রক্রিয়ায় গ্রামসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ ক্রমশ ব্যাপকতর হইতেছে, ইহা ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি বড় সাফল্য হিসাবে গণ্য করা হয়। ইহা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জনজীবনের বিভিন্ন কাজে, বিশেষত শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টি ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনগুলি পূরণে সরকারি ব্যবস্থা ঠিক মতো কাজ করিতেছে কি না, তাহার যথার্থ তদারকির কাজটি যে একটি সচল এবং সক্ষম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবশ্যিক কর্তব্য, সে কথা অনেক সময়েই মনে রাখা হয় না। মিড ডে মিল প্রকল্পের বেহাল অবস্থা এই সত্যটিকেই চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়াছে। কেবল দুই একটি কমিটি এবং কয়েক ডজন বিবৃতি দিয়া এই অভাব পূরণ হইবার নহে। |