রাত পৌনে এগারোটা। কারশেড থেকে হাওড়া স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে আপ মোকামা প্যাসেঞ্জার। খালি ট্রেনটি পুরোপুরি থামার আগেই মহিলা কামরায় হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লেন জনা তিরিশ পুরুষ। আসন দখল নিয়ে শুরু হল মারামারি। ভয়ে সিঁটিয়ে রইলেন মহিলা কামরার যাত্রী জনা দশেক মহিলা। কিছু ক্ষণ পরেই ট্রেন ছাড়ল। কামরায় চোখে পড়ল না কোনও পুলিশ। অরক্ষিত ভাবেই যাত্রা শুরু করলেন মহিলারা।
সোমবার রাতে হাওড়া স্টেশনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছাড়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনগুলির সব ক’টিরই এই একই ছবি। এক দিন আগেই আসানসোল থেকে হাওড়া আসার সময়ে দুষ্কৃতীর হাত থেকে বাঁচতে চলন্ত জনতা এক্সপ্রেসের মহিলা কামরা থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন এক তরুণী। এই ঘটনার পরে ট্রেনের মহিলা যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কার, তা নিয়ে চাপান-উতোর হয়েছে রাজ্য সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু পরিস্থিতি কি একটুও বদলেছে? |
শহরতলির ট্রেনে সুনসান মহিলা কামরা। —নিজস্ব চিত্র। |
রাত ১১টা নাগাদ বেলুড়ের বাসিন্দা শম্পা তিওয়ারি বসে ছিলেন হাওড়া স্টেশনের সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যান্ডেল লোকালের মহিলা কামরায়। কামরা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পুরুষ যাত্রীরা। দিব্যি চলছে তাস খেলা, হাঁক-ডাক। শম্পাদেবী বলেন, “কোথায় পুলিশ? মহিলা কামরায় কেন উঠেছেন জানতে চাইলে এঁরা বলেন, আমরাই তো পুলিশ! কেউ আবার নিজেদের পরিচয় দেন রেলকর্মী বলে।” ওই ট্রেনেরই যাত্রী ভদ্রেশ্বরের অসীমা পাল বললেন, “নিত্যদিনই আতঙ্কের মধ্যে রাতের ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়।”
একই ছবি শিয়ালদহেও। স্টেশনের মহিলা যাত্রীদের অভিযোগ, রাত ৯টার পরে কোনও ট্রেনের মহিলা কামরাই আর নিরাপদ থাকে না। যাত্রীদের অভিযোগ, এখানেও পাহারা থাকে না। রেল পুলিশ বা রেলকর্মী পরিচয় দিয়ে এক দল পুরুষ রোজ মহিলা কামরায় যাতায়াত করেন। প্ল্যাটফর্মে টহলদার রেল পুলিশের এক অফিসার বললেন, “কাকে কী বলবো। যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরাই তো নিয়ম মানেন না। নিজেদের বন্ধু, পরিচিতদেরও তুলে নিচ্ছেন মহিলা কামরায়। তা দেখে অন্য লোকেরাও মহিলা কামরায় ওঠে।”
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মাহাপাত্র বলেন, “ডিউটি না থাকলে কখনওই মহিলা কামরায় ওঠা যায় না। ডিআরএম ও আরপিএফ-কর্তাদের বিষয়টি জানাবো।” রেল পুলিশের এডিজি অমর সরকার বলেন, “মাঝে মধ্যেই বিশেষ চেকিং করা হয়। এ বিষয়ে আরও জোর দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হচ্ছে মহিলা কামরায়।”
শুধু রাতেই বা কেন? হাওড়ার বিভিন্ন শাখার নিত্যযাত্রীদের ক্ষোভ, মহিলা কামরা কিংবা লেডিজ স্পেশ্যালে বেশ কিছু পুরুষ অফিসযাত্রী ও ছাত্র নিয়মিত যাতায়াত করে। অভিযোগ, তাদের অভব্য আচরণে অতিষ্ঠ মহিলা যাত্রীরা। কয়েক বছর আগে এমন ঘটনার প্রতিবাদ করায় বেলানগর স্টেশনে নেমে বেপরোয়া ভাঙচুর চালিয়েছিল মহিলা কামরায় যাতায়াত করা কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র। এই ঘটনার পরে রেল কর্তৃপক্ষ কড়া ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু কিছুই বদলায়নি। এখনও সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত হাওড়া শাখার বিভিন্ন লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরার দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকে ছাত্ররা। বেলানগরের বাসিন্দা কলেজ পড়ুয়া সম্পৃক্তা ঘোষ বলেন, “ওরা বয়সে ছোট। কিন্তু তাদের আচরণ দেখে আমাদের লজ্জা হয়। কিছু বললে আরও বেশি করে অভদ্রতা করে।” যাত্রীদের অভিযোগ, হাওড়া থেকে ছাড়া ট্রেনগুলিই নয়, রাতের ডাউন ট্রেনগুলির মহিলা কামরাতেও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। মহিলা কামরার পাহারায় থাকা রেল পুলিশরা বেলুড়ে নেমে যান। কেন না, সেখানেই তাঁদের রাইফেল জমা রাখতে হয়। এর ফলে বেলুড় থেকে হাওড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ অরক্ষিত থাকে মহিলা কামরা। |