|
|
|
|
সত্যজিতের সঙ্গে ওর একটা ঠান্ডা লড়াই ছিল |
মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পরেও উত্তমকুমার তাঁর জীবনে এমনই চলমান আগ্নেয়গিরি যে, ক্রমাগত লাভাস্রোত হয়েই
চলে। এই ইন্টারভিউটা দিতে বসে তাই সুপ্রিয়া দেবী একবার বলছেন, পরমুহূর্তেই গৌতম ভট্টাচার্যকে
অনুরোধ করছেন, থাক, কেটে দাও... আচ্ছা না, একটু রাখতে পারো... এ ভাবেই চলল |
অনেকে বলে উত্তম মারা গিয়েছেন অনিয়ম আর বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য। মৃত্যুর আগের দিন রাত্তিরেও নাকি অঢেল মদ খেয়েছিলেন? হায় ভগবান! ছি ছি ছি! একদম ভুল ধারণা। এটা আমিও শুনেছি। প্রথমত, ও ড্রিঙ্ক করত একমাত্র শনিবার। তাও দু’-তিন পেগের বেশি কখনওই নয়। আমায় বলো না, যে লোকটা ভোর পাঁচটায় উঠে মর্নিং ওয়াক করবে, সে কি অনেক রাত্তির অবধি কখনও মদ খেতে পারে? তার তো ঘুমোনোর একটা সময় দরকার, নাকি? দেবেশ ঘোষের বাড়িতে সে দিন রাত্তিরে ডিনারে আমিও ছিলাম। পরের দিন যেহেতু উত্তম মারা গেল সেটা ইস্যু হয়ে গেল।
আগে তো উনি ময়দানে মর্নিং ওয়াক করতেন?
হ্যাঁ, তার পরে উনি চোখের সামনে দেখলেন একটা খুন হতে। তখন নকশালদের উত্তপ্ত সময়। রেড রোড দিয়ে স্পিডে আসা একটা কালো গাড়ি ওর সামনে থেমেছিল। রীতিমতো শাসানি দিয়ে বলেছিল, উত্তমদা আপনি কিছু দেখেননি। তার পর আর কখনও ময়দান চত্বরে যাননি। সেই দিনটা খুব আপসেটও ছিল ও। পর পর দু’-তিন দিন শ্যুটিং করেনি। উত্তমের জীবনে বোধহয় এমন ঘটনা নেই।
পরে কখনও ভেবেছেন এত কম বয়েসে উনি চলে গেলেন কেন? স্ট্রেস-টেনশন-স্টারডম সব মিলে মিশে খেয়ে ফেলল? এখন যেমন হার্টের বড় বড় ডাক্তার কলকাতা শহরে আছেন, তখন বিশেষ কেউ ছিলেন না। সিক্সটিজের শেষ দিকে যে বার ওর হার্ট অ্যাটাক হল, তখন বাংলাতে ভাল হার্টের ডাক্তার নেই বললেই চলে। একমাত্র সুনীল সেন। সুনীলদাও বলিহারি। নিজে সিগারেট খেয়ে উত্তমকে বলছেন, তুমি একদম খাবে না। এটা কোনও কথা হল! |
|
১৯৮০-র অভিশপ্ত ২৪ জুলাই না এলে উত্তমকুমারের বয়েস হত আজ ছিয়াশি। বেঁচে থাকলে এখন কী ভাবে কাটাতেন উনি? (কিছুটা অন্যমনস্ক) ও বলত, জানি না কত দিন বাঁচব। যদি সেই আয়ু আমার থাকে, ক্যামেরার পিছনে চলে যাব। ব্যাকগ্রাউন্ডে ডিরেক্টর হয়ে নতুন ছেলেদের তৈরি করব। ওদের অ্যাক্টিংটা যাতে স্ট্রং হয়, দেখব। রাইটারদের নিয়ে বসব।
মানুষটা ভাবেওনি তখন যে এত আগে চলে যাবে। আর্টিস্টরা অনেকে আমায় সান্ত্বনা দেয়, চলে গিয়েছেন এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে। দুলাল লাহিড়ি একদিন আমায় বলছিল, বেণুদি, ভাল হয়েছে। দাদা আজ বেঁচে থাকলে সহ্য করতে পারতেন না। পারিপার্শ্বিক যা হয়েছে।
আপনার রান্নার গুণগান সবাই করে। সে দিনও দীপঙ্কর দে বলছিলেন আপনার অদ্ভুত একটা রেসিপির কথা। ডিশটার নাম আমচুর চিকেন। মহানায়ক ডিশটার রেসিপি কী? লোকে বলে ট্যালেন্ট, রূপ এই সব। আমি বলি ট্যালেন্ট তো নিশ্চয়ই। সৌন্দর্য তো নিশ্চয়ই। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে নিষ্ঠা। বারবার নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চাওয়ার চাড়। পারফেকশনে পৌঁছে যাওয়ার জন্য সীমাহীন পাগলামি।
এই যে ইডিয়েট লোকগুলো উত্তমের বেহিসেবি জীবনযাপনের কথা বলে, তাদের কোনও ধারণাও নেই, ও কী পরিমাণ পড়াশোনা করত। নিজে নিজে শেক্সপিয়র পড়ত। লা’ মার্টিনিয়ারের প্রিন্সিপাল আর ওঁর স্ত্রীর কাছে রোববার করে ইংলিশ পড়তে যেত। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ভাইস। ১৯৬৫-৮০ এই ক’টা বছর ও নিয়মিত ভাবে ইংরেজি রপ্ত করার চেষ্টা করে গেছে। ওর একটা ভীষণ আক্ষেপ ছিল ইংরেজি মিডিয়ামে না-পড়ায় ইংলিশ বলাটা রপ্ত হয়নি। বেচারিকে তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢুকতে হয়েছিল। যথেষ্ট পড়তে পারেনি। এটা নিয়ে ওর খুব মনখারাপ ছিল। যা শুনলে আমারও খুব খারাপ লাগত। ছেলেকে তাই ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছিল। উত্তম নিজে আবৃত্তি করত। রোজ পুজোর সময় সংস্কৃত পড়ত। পুজোর মন্ত্র পড়ে পড়ে মুখের জড়তা কাটাত। সংস্কৃত ছিল ওর ফেভারিট সাবজেক্ট। মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো ওর অধ্যবসায়। এক বার আমি বাথরুমে চান করতে ঢুকেছি। শুনছি ঠিক বাইরের ঘরে দু’-তিনটে গলা। আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেছি, এখন ভিজে কাপড়ে বেরোবো কী করে? কিছুক্ষণ ওয়েট করার পর, উঁকি মেরে দেখলাম ঘরে উত্তম একা। তবে লোকগুলো গেল কোথায়? পরে জানলাম, কেউ আসেনি। উত্তম একাই তিনটে রোল প্র্যাকটিস করছিল।
তার মানে একেবারে ডেডিকেটেড ছিলেন? এত সিনসিয়র মানুষ আমি দেখিনি। যা করত গভীরে ঢুকে করত। গানের মাস্টার আসত ওর। দেখতাম যত ক্ষণ না গলার ভেতর গানটাকে নিতে পারছে, তত ক্ষণ ছাড়ছে না। দেড় ঘণ্টা-দু’ ঘণ্টা হয়ে গেছে, তবু ছাড়ছে না। ‘ছোটি সি মুলাকাত’য়ের সময় নাচ শিখত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে, ঘেমে যাচ্ছে, তবু থামছে না। আমি বললাম এটা কী হচ্ছে। এ বার থামো। বলল, না, বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে নাচতে হবে। আমায় পারফেক্ট হতেই হবে।
শোনা যায় ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ফ্লপ করার পেছনে রাজ কপূরের হাত ছিল? আমি এটা মন থেকে বিশ্বাস করি না। আমি বরঞ্চ বলতে চাই, কালো হাত যদি কারওর থেকে থাকে, তবে উত্তমের আশেপাশের কিছু লোকেদের। যাদের ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত। মানুষটার এই একটা দোষ ছিল কাছের লোকেদের কথায় চলত। অথচ রাজজি ওকে খুব ভালবাসতেন। ‘সঙ্গম’য়ে ওকে কাস্টও করেছিলেন। যে রোলটা পরে করল রাজেন্দ্রকুমার। টাকাপয়সা, কথাবার্তা, বোম্বে যাওয়া সব ঠিক। হঠাৎ কাছের কতগুলো লোক এসে গোটা ব্যাপারটাকে ঘুরিয়ে দিল। তারা বোঝালো, তুই হলি কলকাতার রাজা, তুই গিয়ে রাজের আন্ডারে কাজ করবি! মানায় তোকে? এ সব শুনে-টুনে উত্তম গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর আর বোম্বে গেলও না। |
রাজ কপূরের সঙ্গে উত্তম-সুপ্রিয়া |
রাজ তার পর রেগে গিয়ে প্রতিশোধ নিলেন?
রেগে গেলেন কি না জানি না। কিন্তু অফারটা যে নিল না, সেটা বোধহয় ওঁর ভয়ঙ্কর আঁতে লেগেছিল। এর বেশ কয়েক বছর পর রাজজি আমাদের বাড়িতে খেতে এসেছিলেন। তখন বললেন, উত্তম তুমি মুম্বইতে কাজ করলে অথচ আমার ছবিতে করলে না। খুব অভিমান হয়েছিল রাজজির। কিছুতেই ভুলতে পারেননি।
আপনি ক্ষতিকারক এই সব চামচেদের দূরে পাঠালেন না কেন? কুড়ি বছর ধরে টানা বলে গেছি। একবার বোম্বেতে বসে অনেক বুঝিয়েছিলাম, এই কাছের লোকগুলো তোমার সর্বনাশ করছে, এদের তুমি পাত্তা দিও না। আমার বাড়িতে একবার এ রকম একটা লোককে দেখে চিৎকার করেছিলাম, এ এখানে কী করছে? আর একবার উত্তম এক্সারসাইজ করছে। কোথা থেকে দু’জন লোক চলে এল। আমি তো অবাক। তাদের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, বেশ ঘনিষ্ঠ। আমি বললাম, মানুষটার তো ব্যক্তিগত জীবন আছে, না কি? এখন যান তো। উত্তমকে আমি অনেক বলেছিলাম, তুমি কি এখনও বুঝছ না, ‘সঙ্গম’ না-করাটা কত বড় ব্লান্ডার হল? এই লোকগুলো তোমায় ভুল বুদ্ধি দিচ্ছে।
তাতেও হল না? না, একজন বড় মাপের মানুষ যদি এক রকমভাবে ভাবে, তাকে কী করে আটকানো যায়? প্রত্যেক মানুষের একটা নিজস্বতা থাকে। সেখানে বারবার যদি ঢোকার চেষ্টা করো, তার দিক থেকে সে বিরক্ত বোধ করতেই পারে। সে জন্য একটা সময় ঠিক করে নিই, এ ব্যাপারে আমার কিছু না-বলাই ভাল।
উত্তমের কী মনোভাব ছিল রাজ সম্পর্কে? খুব শ্রদ্ধা করতেন রাজজিকে। দিলীপ কুমারকেও খুব রেসপেক্ট করতেন। একবার আমরা মুম্বইতে সান অ্যান্ড স্যান্ড হোটেলে ঢুকছি। হঠাৎ দিলীপ কুমারের মুখোমুখি, শ্যুটিং করতে ঢুকছেন। দেখা মাত্র দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরলেন। দিলীপ বললেন, এই যে আমার কাউন্টার পার্ট, কেমন আছ?
আজকের মিডিয়া অধ্যুষিত ২৪x৭ চ্যানেলের যুগে উত্তমকুমার কী করতেন? আমার মনে হয়, ও পাগল হয়ে যেত। তখন এত মিডিয়া-টিডিয়া ছিল না, তাতেই ওর কী অবস্থা ছিল। বেচারি কোথাও বেরোতে পারে না। পুজো প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখা মানে, পঞ্চমীর দিন গভীর রাত্তিরে এক-দু’ মিনিট উঁকি মারা। তাতেও কী ভিড় জমে যাচ্ছে। চারদিক থেকে গুরু, গুরু। ট্রেনে অবধি ওঠার উপায় নেই। আমরা গরু-ছাগলে ভরা দুর্গন্ধের কম্পার্টমেন্টে বসে থাকতাম। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে ড্রাইভার বা গার্ড এসে বলত, সাহেব এ বার আপনার সিটে চলে যান।
আমি রাজ কপূর দেখেছি, রাজেশ খন্না দেখেছি। দিলীপকুমারকে বোম্বেতে দেখেছি। কাউকে নিয়ে এই ক্রেজ দেখিনি। এমন ঘিরে ধরত পাবলিক চারধার থেকে যে, ও রীতিমতো ভয় পেয়ে যেত। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে লোকে টানাটানি করত। আমার এমনিতেই ওকে একদিন না-দেখলে শরীর খারাপ হয়ে যেত। তার ওপর এই ক্রেজ! প্রতিবার বেরোলে খুব স্কেয়ার্ড থাকতাম। উত্তম সত্যিই সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছিল! আউট অ্যান্ড আউট!
অন্য ধরনের ছবি করতে হলে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু সৌমিত্র যেখানে চোদ্দোটা সত্যজিৎ-ছবির নায়ক, সেখানে উত্তম মাত্র দু’টো। সৌমিত্র তো ‘নায়ক’টাও করতে চেয়েছিল। তখন মানিকদা ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, কেন উত্তম (হাসি)! সেই কারণটা আজ আর বলছি না। পুলু আমার খুব ভাল বন্ধু। শুধু এটুকু বলতে পারি, ‘নায়ক’ উত্তমকে দেখেই মনে হয়। ক্যারিজমা উত্তমকে দেখেই মনে হয়। প্রেমিক উত্তমকে দেখেই মনে হয়। সৌমিত্র ভাল অভিনেতা নিশ্চয়ই। আমার খুব ভাল বন্ধুও। কিন্তু নিত্য নতুন প্রেমে পড়ানোর ওই যে লুক, ছোট ছোট দিক, সেটা আমি সৌমিত্রর মধ্যে কখনও দেখিনি।
তা হলে, সত্যজিৎ-উত্তম আরও কাজ হল না কেন? মানিকদা অসম্ভব ট্যালেন্টেড একটা মানুষ সবাই জানে। মানিকদার প্রচুর ইগোও ছিল। কোথাও একটা উত্তমের সেটা মেনে নিতে সমস্যা হত। ওদের সম্পর্কটা তাই একটা ঠান্ডা জায়গাতেই থেকে গিয়েছিল। অথচ ফ্লোরে যখন দু’জনে শ্যুটিং করতেন, ওঁদের মধ্যে কী দারুণ সম্পর্ক। দেখে বোঝার উপায়ই নেই একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব যে রয়েছে।
সেটা হবে কেন? দু’জনেই তো পেশাদার? এমনিতে দু’জনের বেশ ভাল রিলেশন ছিল। কিন্তু উত্তম যে অ্যামাউন্ট চাইত, সেটা সত্যজিৎ রায় কিছুতেই দিতে চাইতেন না। ‘নায়ক’ করতে গিয়েই তো কত কাণ্ড হল। কথাবার্তায় উনি বুঝিয়ে দিলেন, আমার ছবিতে কাজ করার জন্য তুমি বিদেশ যেতে পারবে। তার ওপর আমার ছবিতে কাজ করছ, বেশি টাকা নেবে কেন? উত্তম বলেছিল, বেশি তো নয়, আমার যা রেট তাই তিন লাখ টাকা।
ভাল ছবির জন্য উত্তম তো রেট কমাতেই পারতেন। শুনেছি অনেক অনামী পরিচালককে কার্যত বিনা টাকায় কাজ করে দিয়েছেন? করেছে ঠিকই। কিন্তু ও বলত, মানিকদার প্রোডিউসরের তো টাকার অভাব নেই। সবচেয়ে বড় কথা টাকাটা তো আর উনি নিজে দেবেন না। দেবে প্রোডিউসর আর ডি বনশল। তাহলে উনি এত হিসেব করছেন কেন? আমার মনে হয়, ওর ভেতরে কোথাও একটা লেগেছিল, এত ইগো কীসের? তুমি সত্যজিৎ রায় হতে পারো, আমিও তো উত্তমকুমার। এত বছর তো আর আমার কাছে আসোনি। তাহলে আজকে ‘নায়ক’ করাতেই বা আসছ কেন? যাও সৌমিত্রকেই দিয়ে করাও।
ও তাই হেসে সরাসরি মানিকদাকে নয়, ওর প্রতিনিধিকে বলে দিল, উত্তমকুমারকে দিয়ে কাজ করাতে হলে এই টাকাটাই দিতে হবে। আর একটা কথা বলেছিল, মানিকদাকে বলে দেবেন, বিদেশ যাওয়ার অত ইচ্ছে-টিচ্ছে আমার নেই। বহু ঝামেলা করে তারপর মিটল। এর পর ‘চিড়িয়াখানা’তেও ও মানিকদার সঙ্গে কাজ করেছিল। দু’জনের সম্পর্কটা কিন্তু দারুণ মসৃণ হয়নি। ওপর ওপর যদিও ভাল ছিল। আজ ভাবলে মনে হয়, মানিকদাও যে খুব এগিয়ে এসে ঠান্ডা ব্যাপারটা মেটাতে চেয়েছিলেন এমন নয়। ‘নায়ক’য়ের শুরুর দিককার শ্যুটিংয়েই তো বললেন, “তোমার মতো করে করো, তুমি তো টপ স্টার।”
মৃণাল সেন বরাবরের সত্যজিৎ প্রতিদ্বন্দ্বী। উত্তমের কখনও মনে হয়নি যে, ঠিক আছে উনি সৌমিত্রকে নিয়ে পড়ে আছেন থাকুন। আমি মৃণালকে নিয়ে দেখিয়ে দেব। ওঁর ছবিতে টানা কাজ করব। এই জাতীয় মানসিকতা উত্তমের ছিলই না যে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা ভাববে। ও নিজের স্টেটাস সম্পর্কে, নিজের জায়গাটা সম্পর্কে এত কনফিডেন্ট ছিল যে, এ সব ভাবেইনি। ঋত্বিক ঘটককেই কখনও পাত্তা দেয়নি। আমার কাছে ঋত্বিকদা একজন বিশাল, বিশাল পরিচালক। কিন্তু উত্তমের তখন ওই ধরনের ছবি আর পরিচালক সম্পর্কে কোনও আস্থাই ছিল না। |
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। |
‘মেঘে ঢাকা তারা’ উনি নিশ্চয়ই দেখেছিলেন? দেখেছিলেন আমার সঙ্গে ঘর করার দশ বছর বাদে। ওই সব ছবিকে বলতেন গ্ল্যামারাস নয়, দেখে কী হবে? কাছের লোকেরাও তাতে তাল দিত। প্রোজেকশনে যখন উনি ছবিটা দেখতে বসেন দু’-একটা ও রকম কাছের লোক ঢুকে গিয়েছিল। আর এসে বকবক করছিল, এ সব ছবি করে কী হবে? কালিঝুলিতে চলবে না। তখন উনি আবার তাদের ধমকালেন, তোমরা ছবি দেখতে এসেছ, না বকবক করতে? স্ট্রেট বার করে দিলেন। চার পাঁচ বার তার পর ছবিটা দেখেছিলেন। আজ ভাবলে অবাক লাগে, যে-উত্তমের সো কল্ড আর্ট ফিল্ম সম্পর্কে ওই রকম মনোভাব ছিল, সেই মানুষটাই কিনা কেরিয়ারের শেষের দিকে উইদাউট মেক আপ ‘যদুবংশ’ করল। ‘অগ্নীশ্বর’ করল। ও রিয়েলাইজ করেছিল। কিন্তু বেচারি সময়টাই পেল না।
ওঁর পরেও টালিগঞ্জে এত নায়ক এসেছেন। রঞ্জিত। প্রসেনজিৎ। জিৎ। দেব। এঁদের আগে সৌমিত্র। তফাতটা কীসে থেকে গেল? আমার মনে হয়, চেহারাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর। লম্বা চওড়া চেহারা। তবে তারও আগে ওই হাসি। ওই হাসি আর কোনও নায়কের নেই। ভুবন ভোলানো হাসি। আর যে ভাবে তাকাত, সেটাও ভীষণ রোম্যান্টিক। কুড়ি বছর একসঙ্গে থেকেও মনে হত, যেন প্রতিদিন নতুন করে প্রেমে পড়ছি। এমন ছোট ছোট এক একটা ব্যাপার ছিল। চাউনিটা এমন যে, রোম্যান্স আর সেক্স অ্যাপিল ভরা। যাতে বিদ্ধ না হয়ে তোমার উপায় নেই।
বেড রুম আইজ? জানি না বাবা ও সব। তবে ওই এক চাউনিতেই মাত। সকালে দেখলে দিনভর রেশ থেকে যায়।
অনেকে মনে করে, গুরু ডাকটা আর কারওকে মানাত না। ঠিক তাই। সেই মাদকতাটা ওর সমসাময়িক আর কারওর মধ্যে ছিল না। উত্তমের মধ্যে একটা অদ্ভুত আবেদন ছিল। তুমি হ্যালো বলার আগেই তোমাকে মিষ্টি করে তাকিয়ে হ্যালো বলে দিল। আর তোমার মনটা জিতে নিল। কথা বলার অদ্ভুত স্টাইল ছিল ওর। সাধারণ অথচ অসাধারণ। আমি তো টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে দেখেছি উত্তম চলে যাওয়ার কত বছর বাদেও সিরিয়ালের নায়িকা-টায়িকারা আমায় জড়িয়ে ধরছে। আমি বললাম একি একি! তখন বলছে, ওকে তো পেলাম না, তোমায় একটু জড়িয়ে নিই। একেই বলে ক্যারিশমা। এটা রাজ কপূরের মধ্যেও ছিল।
সৌমিত্রর সঙ্গে ওঁর একটা লড়াই ছিল। বাঙালি তখন উত্তম-সৌমিত্র দু’ভাগে ভাগও হয়ে গিয়েছিল। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে উনি কী ভাবতেন? আমার মনে হয় না, ওর মনে কোনও লড়াই ছিল। একদমই ছিল না। উত্তম নিজেকে জানত। কাউকে মনেই করেনি প্রতিদ্বন্দ্বী। সৌমিত্রকে অবশ্য ও স্নেহ করত। একবার বসুশ্রীর ফাংশনে সৌমিত্র সবাইকে প্রণাম করল, ওকে করল না। উত্তমের একটু অভিমানই হল। বলল, কীরে পুলু, দাদাকে প্রণাম করতে ভুলে গেলি!
তার পর কী হল? তার পর সৌমিত্র সঙ্গে সঙ্গে এসে প্রণাম করল।
কম বয়েসে খ্যাতির তুঙ্গে চলে গেলে মানুষের মনে চিরস্থায়ী থেকে যাওয়া যায়। জন এফ কেনেডি যেমন আজও আমেরিকার সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্ট। মাত্র চুয়ান্ন বছরে চলে গিয়ে উত্তমও মহানায়ক হিসেবে অমর হয়ে গিয়েছেন। কেউ তাঁকে থুত্থুড়ে বুড়ো হিসেবে দেখারই সুযোগ পেল না। কী জানি, মন তো মানে না। আমার সঙ্গী আমার বন্ধু এত বছর একসঙ্গে থাকা। সে-ই তো চলে গেল। এক এক সময়ে মনে হয় কার সঙ্গে কথা বলব? কী বলব? এই যে মর্নিং ওয়াকে খুব সুইটলি জিজ্ঞেস করত, আজ কী করে খাওয়াবে আমাকে বলো তো? প্রশ্নটাই তো জীবন থেকে হারিয়ে গেল।
কিন্তু এত বড় স্টারের তো স্ট্রেসও নিশ্চয়ই প্রচুর ছিল? শুক্রবার ছবি রিলিজের দিনগুলো কেমন যেত? ওরে বাবা, মারাত্মক টেনশন। ছবি রিলিজের ঝামেলা থাকলে, অনেক সময়ই শহর ছেড়ে ও চলে যেত। তোপচাঁচিতে গভর্নমেন্টের একটা লেক-বাংলো ছিল। খুব সুন্দর। সামনে পাহাড়। চারধারে ঝরনা। সেখানে চুপটি করে বসে থাকত। ‘অমানুষ’ যে বার রিলিজ করল, ওর কী টেনশন। আসলে টেনশনও না, ও শিওর ছিল ছবিটা সুপার ফ্লপ হবে। সে বারও আমরা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। এ বার তোপচাঁচিতে হঠাৎ ফোন গেল, ‘অমানুষ’ প্রথম দিনই সুপার ডুপার হিট। উজ্জ্বলার সামনে ট্রাম রাস্তার ওপরে লোক ভিড় করে আছে। আর টিকিটের জন্য মারপিট হচ্ছে।
এই যে সবাই উত্তম-সুচিত্রা করত। আপনার কখনও মিসেস সেনকে হিংসে হয়নি? আমার হিংসে হয়নি। আমি মিসেস সেনকে শ্রদ্ধা আগেও করতাম, এখনও করি। তবে এক এক সময় খারাপ লাগত, ছবির কনট্র্যাক্ট হওয়ার সময় ওর নামটা আগে না-এসে সুচিত্রার নাম প্রতিবার আগে আসত। রমাদি আসলে কনট্র্যাক্টের সময়ই বলে নিতেন।
উত্তমের নিজের ভাল লাগত নাম পরে যাওয়াটা? মুখে কিছু প্রকাশ করেনি কখনও। বরঞ্চ বলত, আমি খুব ভদ্র। দেখছ তো লেডিজ ফার্স্ট কী রকম মানি! কথা শুনেই বুঝতাম স্রেফ কভার আপ করার জন্য বলছে। আমি দ্রুত তর্ক জুড়ে দিতাম, তা হলে আমার নামটা পরে দাও কেন? কেন আমার বেলা লেখো উত্তম-সুপ্রিয়া? আমি বুঝি লেডি নই?
উত্তম কুমার বেঁচে থাকলে সুচিত্রার মতো স্বেচ্ছা নির্বাসনের কথা ভাবতেন? রমাদি ভীষণ চালাক, যেই দেখলেন-চেহারাটা আগের মতো গ্ল্যামারাস নেই। রোম্যান্টিক রোলে আর আগের মতো লাগবে না, সেই সরে গেলেন।
জিজ্ঞেস করছিলাম, উত্তম কি বেঁচে থাকলে আড়ালে চলে যেতেন? ও এই সবের মধ্যে যেত না। উত্তম খুব মিশুকে ছিল। অভিনয় আর করত না। ডিরেকশন দিত। ও নিশ্চয়ই ভাবত একটা দেওয়ালের মধ্যে ভূতের মতো বসে থেকে লাভটা কী? তা ছাড়া উত্তম প্রত্যেক জুনিয়রকে জড়িয়ে ধরে কাজ করতে ভালবাসত। কাউকে কখনও ছোট করেনি।
আজকের দিনে উত্তম-সুচিত্রা চলত?
আমার তো মনে হয় চলত। রোম্যান্সের আবেদন সব যুগেই সমান। কথা হল সেই রকম রোম্যান্টিক ছবি বানানোর লোক উত্তম এই যুগে পেত কি না! ডিরেক্টর হয়েও কি
এই রকম একটা জুড়ি বার করতে পারত ও? আজকালকার ছেলেমেয়েরা রোম্যান্স করবে কী, প্রেমেও তুই-তোকারি করছে।
সুপ্রিয়া-উত্তম মানে সবাই জানে ময়রা স্ট্রিট। আজকের দিন হলে আপনারা নির্ঘাত বিয়ে করে নিতেন। সমাজ অনেক উদার হয়ে গেছে। বিয়ে তো হয়েছিল আমাদের।
রেজিস্ট্রি হয়েছিল? না, রেজিস্ট্রি করা যায়নি, ওর ডিভোর্স হয়নি বলে। তবে বিয়ে হয়েছিল। আমার বাবা নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। সাত পাক ঘোরাও হয়েছিল। বাবা পরিষ্কার বলেছিলেন, একসঙ্গে থাকতে হলে বিয়ে করতে হবে।
পরবর্তী কালে যখন লোকে বিয়ে নিয়ে নানান কথা বলেছে, তখন খারাপ লাগেনি? খারাপ লাগলে, কী করা যাবে! সবচেয়ে বড় কথা, ভেবে কী করব? আমরা নিজেরা জানতাম আমরা মেন্টালি ম্যারেড। সবার আগে মন কথা বলে। সেটাই তো রায় দিয়ে দিয়েছিল।
আর পাঁচটা বিয়েতে যেমন হয়। কালরাত্রি-ফুলশয্যা সব হয়েছিল?
সব হয়েছিল, আত্মীয়-স্বজন সব এসেছিল। ১৯৬২-র ২ ডিসেম্বর আমাদের বিয়ে হয়। বিভূতিদা, পীযূষদা, অসীম সরকার সবাই এসেছিলেন। এর পর ৫ ডিসেম্বর বিশাল পার্টি হল, যেখানে হোল ইন্ডাস্ট্রি ছিল।
স্বামী হিসেবে খুব পোজেসিভ ছিলেন?
ওরে বাবা, মারাত্মক রকমের। একবার কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে ধর্মেন্দ্র এসে আমায় ফোন করেছে। উত্তম যেতে দিল না। বলল, না, তুমি কিছুতেই যাবে না। বোম্বেতে কিশোর কুমারের সঙ্গে শ্যুটিং করছি। ও গিয়ে হাজির। বলল, কিছুতেই কাজ করবে না, ফিরে চলো। বাড়িতেও কারওর আসার উপায় নেই। আমি রেগে বললাম, তোমার যা অ্যাটিচিউড, একটা মদ্দা মাছিও বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। তুমি নিজে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বসে থাকবে, অথচ আমার প্রোডিউসার ঢুকতে পারবে না। এক প্রস্ত ঝগড়া হল, তার পর দু’জনেই জোর হাসলাম।
প্রচুর মহিলা ওঁকে ঘিরে থাকত? হ্যা।ঁ তাদের আবার আমি এন্টারটেন করতাম। বলতাম, কোক খাবে? খাবার খাবে?
ধুর। এগুলো আজকে আপনি বলছেন। তখন নিশ্চয়ই ভয়ে ভয়ে থাকতেন এই বুঝি আমার উত্তম হাতছাড়া হয়ে গেল। আরে না না। আমি জানতাম, নিজের জায়গায় ঠিক আছি। বেশ মজাই লাগত। আর নিজেকে বলতাম, তোদের প্রচুর খাইয়ে খাইয়ে মোটা করে দেব।
প্রথমে দীর্ঘদিনের ময়রা স্ট্রিট, তার পর লাউডন স্ট্রিট ছেড়ে এখন নিউ আলিপুরের বুড়োশিবতলা রোডের বাসিন্দা। এত কালের পুরনো পাড়া ছেড়ে খারাপ লাগছে না? বিশেষ করে যেখানে পুরনো পাড়াটায় একটা উত্তম-উত্তম গন্ধ ছিল? খুবই খারাপ লাগছে। ফ্ল্যাটটায় মনই টিকছে না। এক একবার ভাবছি ফিরে যেতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু অর্থকষ্টর ব্যাপারটা মাথায় রাখতে গেলে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়।
জুলাই মাসটা এলেই কি মন খারাপের থার্মোমিটার চড়তে শুরু করে? নাকি মনে হয় আবার তো দেখা হবেই ওপরে গিয়ে? মনখারাপ তো সব সময় হয়। এ ভাবে এত তাড়াতাড়ি যে ও চলে যেতে পারে আমার কোনও অলক্ষুনে কল্পনাতেও আসেনি। তবে উত্তমের সঙ্গে আবার দেখা হবে, সেই বিশ্বাস আমার নেই। আমি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করি না। জন্মান্তর যদি সত্যিই হত, আমার যে সব প্রিয়জন চলে গিয়েছেন অনেক বছর, তাঁদের কাউকে না কাউকে তো এই পৃথিবীতে দেখতে পেতাম।
জীবন একটাই। তার পর সব শেষ। আর সেটা খুব নির্মমও। তুমি যা দিলে টিলে, এখনই যদি পেলে তো পেলে। পরে কেউ মনে রাখবে না। শক্তি সামন্ত খুব বলতেন, “রাত গয়ী, বাত গয়ী।” এই আশি বছরে এসে আমার মনে হয় কথাটা ঠিক।
ভুলে যাওয়াটাই জীবন!
সুপ্রিয়া দেবীকেও কি টালিগঞ্জ মনে রেখেছে? কেউ খোঁজ নেয়? কেউ ডাকে আমায়? |
|
|
|
|
|