|
|
|
|
পুরুষোত্তম |
অরুণকুমার থেকে উত্তমকুমার। ‘গলি থেকে রাজপথ’-এর মধ্যে অনন্ত স্বর্ণালি কাহিনি। ভবানীপুরের
সাদা-কালো দিনের অজানা সেই সব রঙিন গল্প উত্তমের নাতি-নাতনিদের কাছে রূপকথা! শুনলেন নিবেদিতা দে |
• “গুরু ট্যাক্সি ভাড়া দেয়নি।”
ট্যাক্সি ভাড়া!! বাড়ির দরজায় সটান আগন্তুক ট্যাক্সিচালকের এমন কথায় হতভম্ব স্বয়ং ‘গুরু-পুত্র’ গৌতম। কীসের ট্যাক্সি...
• আরে ‘এনটিওয়ান’ স্টুডিয়োর সামনে থেকে উঠল...গেল টালায়...সেখানে এক নায়িকা অঞ্জনা ‘ভোমিকে’র বাড়ি...ভাবছি এই আসবে, এই আসবে...যাচ্চলে! শুনলাম ম্যাডামের গাড়ি করেই হুশ! গাড়ি চড়া মানুষ তো গুরু, ভুলেই গেছে আমার কথা।
মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভবানীপুরের গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে খানিক অপরাধীর মতোই দাঁড়িয়ে বেচারা ট্যাক্সিচালক। |
মুহূর্তে ব্যাপারটা বোধগম্য করে ফেললেন গৌতম। বুঝতে পারেন কেন ক’দিন ধরে ‘বাবি’ বিকেলের ভিজিটটা আর দিতে পারছে না এই বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে তখনকার দিনে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করেন ট্যাক্সিওয়ালাকে, যাতে মামির (গৌরীদেবীর) কানে খবরটা না যায়।
এই ছিলেন উত্তমকুমার। ফ্ল্যামবয়েন্ট... এক বার কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল তো চলো পানসি বেলঘরিয়া। কে কী ভাবল, বলল...ধুস্স্। ‘এই তো জীবন...যাক না যে দিকে যেতে চায় এ প্রাণ...’। আড্ডা-আমোদের যেন এক টগবগে টাট্টুঘোড়া। কিংবদন্তি সেই হাসির আড়ালেই যাঁর লুকিয়ে ছিল ভাললাগা-আবেগের এক হুজুগে আবেশ। যে আবেগ-আবেশে বিন্দুমাত্র টোল পড়েনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আর বাবার মুখে, বাড়ির বড়দের কাছে শুনে দাদুর সেই সমস্ত দুষ্টু-মিষ্টি গল্প আজ জানা হয়ে গিয়েছে নবমিতা-গৌরব-মৌমিতার। উত্তমের নাতি-নাতনিদের। দাদুর সেই গল্পগুচ্ছ আজও যেন উত্তমের গিরীশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাড়ির স্বর্ণালি রূপকথা। বাড়ির ইট কাঠ পাথরে কান পাতলেও যেন শোনা যায় সেই সব সোনা-ঝরা কাহিনি। |
|
অ্যাপল অ্যাপ স্টোর (আই ফোন) অথবা গুগল প্লে স্টোর
(অ্যান্ড্রয়েড) থেকে ABP AR Appটি ডাউনলোড করে পাশের ছবিটি
স্ক্যান করুন। আর দেখে নিন মহানায়কের সঙ্গে তাঁর নায়িকাদের বিরল কিছু ছবি |
|
‘ফিল্মের জোড়াসাঁকো’! |
আজ ২৪ জুলাই। উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন। পার হয়েছে তেত্রিশটা বছর। কিন্তু এই তেত্রিশ বছর বাদেও বঙ্গদেশের নানা প্রান্ত থেকে এই বাড়িতে আজও ছুটে আসেন অগণিত মানুষ! যেন বাঙালির অঘোষিত উত্তম-পুজো।
ঠাকুরদালানে সাজানো উত্তমকুমারের এক বিরাট মাপের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের জলে জানিয়ে যান তাঁদের শ্রদ্ধা! ফুল-মালা-হাতে। ভবানীপুরের ৪৬এ গিরীশ মুখার্জি রোডের এ বাড়ি যেন আজও তাঁদের কাছে ‘ফিল্মের জোড়াসাঁকো’!
নাতি-নাতনিদের কথায়, আজও লক্ষ্মীঠাকুর ভাসানের সময় ‘উত্তমকুমারের বাড়ির ঠাকুর’ জানতে পারলে ট্রাফিক পুলিশ আমাদের লরি আগে আগে ছেড়ে দেন। হাত তুলে নমস্কার জানান। আমরাও বলি, ‘নমস্কার, পুন্ডরীকাক্ষ পুরকায়স্থ’। দাদু ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে পুলিশরূপী জহর রায়কে মজা করে বলেছিলেন এই নাম। বাবার (গৌতম) মুখে শুনে শুনে আমাদেরও এই নামটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে! |
কালকের দিনটা মনে আছে তো? |
৩ সেপ্টেম্বর মহানায়কের জন্মদিন। কিন্তু ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখটাও ছিল এ বাড়ির এক বিশেষ দিন। কারণ সে দিন গৌরীদেবী, উত্তমকুমারের ‘গজু’র জন্মদিন। বাবার মুখে শোনা নবমিতা-মৌমিতার কথায়, “তখন ‘অমানুষ’ ছবির শু্যটিং হচ্ছে মুম্বইয়ে। দাদু সেখানে ব্যস্ত। এমন সময়ে দিদার ফোন“কালকের দিনটার কথা মনে আছে তো...২৭ সেপ্টেম্বর...” ব্যস! পর দিনই দাদু ক্যামেরা ছেড়ে ‘অ্যাকশন’-এ। মুম্বই থেকে সো-জা বাড়ি। হাতে বেনারসি শাড়ি। দিদার জন্মদিনে দাদু বেনারসি শাড়ি-গয়না দেয়নি, এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। কিছু দিন আগেও দিদার আলমারিতে দেখেছি সযত্নে সাজানো দাদুর দেওয়া পঞ্চাশেরও বেশি বেনারসি...দাদু মারা যেতে দিদা কত যে বেনারসি অকাতরে বিলিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। জন্মদিনে দিদাকে দাদুর এই উপহার দেওয়ার কায়দাও ছিল ভারী মজার। দিদার গায়ে ছুড়ে ছুড়ে দিত সেই শাড়ি। বলত, “গজু রেডি? নাও ধরো ক্যাচ।”
আর সেই ক্যাচ মিস হওয়া নিয়ে চলত খুনসুটি। “শুনেছি দিদার সোনার গিনির খুব শখ ছিল। তো দাদু একবার ছোট্ট একটা বটুয়ায় বেশ কয়েকটা গিনি নিয়ে আসে...দিদা তখন ঘুমোচ্ছে। দাদু বলল, ‘আমি খেটে খেটে মরছি আর তুমি ঘুমোচ্ছ’! দিদা বলে, ‘যার যেমন ভাগ্য...আমার ভাগ্য তোমার খাটুনির ফল ভোগ করা।’ উত্তম তখন গৌরীর পাশে বসে বটুয়ার গিনিগুলো তাঁর গায়ের উপরে ফেলতে থাকে। ‘নাও তোমার ভাগ্য নাও...খুশি তো’।
এ রকম ঘটনা অজস্র। জন্মদিন নয়, ১ জুন দাদু-দিদার বিবাহবার্ষিকীর তারিখটাও দু’জনের কাছে ছিল বিশেষ দিন। এক বার অসুস্থতার কারণে বেলভিউতে ভর্তি ছিল দিদা। দাদু সেখানে হাজির। হাতে বেনারসি-গয়না। নার্সিংহোমের কেবিনেই কাটা হয়েছিল কেক! “সো সুইট!” |
সময় বড়ই বিচিত্র |
অনেকেই হয়তো জানেন না, উত্তমকুমারের বাড়ির দোতলায়, তাঁর আতিথ্যে এক সময়ে থাকতেন অনীতা গুহ। ‘সন্তোষী মা’ ছবির সেই মা সন্তোষী। পরে যিনি মুম্বইয়ে বান্দ্রার ফ্ল্যাটে চলে যান।
এ পৃথিবী সত্যিই অদ্ভুত! সময় বড়ই বিচিত্র! এককালে অনীতা ও তাঁর স্বামীকে থাকতে দিয়েছিলেন উত্তম। আর তার বহু যুগ পরে যখন উত্তমপুত্র গৌতম, ক্যানসারে আক্রান্ত, তখন মুম্বইতে টানা চার-পাঁচ মাস চিকিৎসার জন্য অনীতা তাঁর মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দেন গৌতমকে। সম্পর্ক, আবেগ, পারিবারিক পরম্পরার এ যেন এক পারফেক্ট ব্লেন্ডিং!
না, হেমন্ত-মৌসুমী, রাখী, শক্তি সামন্ত বা বাসু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি উত্তম-পরিবার। সুসম্পর্ক থাকলেও বাবার কাছে শুনেছি, ‘‘চিরটাকালই দাদু, বাড়ি ও বাইরের জগৎকে আলাদা রাখতে চাইত। খুব কনজারভেটিভ ছিল।” অনীতাআন্টি বাড়িরই, তা-ই... দাদুর কথা বাবার কাছে শুনে নাতি-নাতনিরাও আঁকড়ে রেখেছে সেই ঐতিহ্য। মজার ঘটনা, আজ গৌরবের শ্বশুরবাড়ি হয়েছে সেই মুম্বইতেই। |
বড্ড কষ্ট হচ্ছে গৌরী |
এখন অভিনয়ের জগতে উত্তমকুমারের নাতি গৌরব। স্ট্রাগল করছে এই দুনিয়ায়। যে কারণে দাদুর জীবন-যন্ত্রণার কাহিনি খুব উজ্জীবিত করে তাকে। “বাবার মুখে শুনেছি ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবিতে দীপঙ্কর দে-র চরিত্রটা দাদুর করার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাদ দেওয়া হয় দাদুকে। রেগে গিয়ে তপন সিংহের বিরুদ্ধে বোধহয় কেসও করেছিল...আসলে চরিত্রটার সঙ্গে এমন ভাবে ইনভলভড হয়ে গিয়েছিল...”। তো এমন অবস্থায় তিনি এলেন গৌরীদেবীর কাছে। তার পর একটা বাঁদর যে ভাবে হাঁটু মুড়ে লাফালাফি করে...অনেকটা সেই ভাবে খাট থেকে মেঝেতে বার বার লাফিয়ে লাফিয়ে অভিনয় করে দেখাতে দেখাতে ... কান্নায় ভেঙে পড়েন। গৌরীদেবীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলেন...‘‘ছবিটা করতে পারছি না...বড্ড কষ্ট হচ্ছে গৌরী...বড্ড কষ্ট...” উত্তমের সেই খাট, সঙ্গের সাইড-টেবিল, ড্রেসিং টেবিল আজও আছে। এসেছে নতুন এক ঝাড়বাতি। |
হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা... |
উত্তমের বাড়ির চারতলার সেই ফ্ল্যাট আজও নতুন করে সেজে উঠেছে গৌরবের স্ত্রী অনিন্দিতার হাতের ছোঁয়ায়। অভিনয় করলেও অনিন্দিতা আদতে চিত্রশিল্পী। মুম্বইয়ের আর্ট কলেজের স্নাতক। তাঁর কেনা ক্রিস্টালের অপূর্ব ঝাড়বাতি ঝলমলিয়ে উঠেছে সেইখানে, যেখানে একসময়ে শোভা পেত উত্তমের পছন্দের অনন্য স্যান্ডেলিয়ার। কালে-কালে সেই ঝাড়বাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, গৌতম লাগিয়েছিলেন আরেকটি ঝাড়বাতি... এ বার অনিন্দিতা। ড্রয়িংরুমের এক দিকের দেওয়ালে সাজানো ভরত পুরস্কারসহ আরও নানা অ্যাওয়ার্ড। তার বিপরীত দেওয়ালে নতুন বৌমা দাদাশ্বশুরের ছবির অসংখ্য পোস্টার একত্রে ল্যামিনেট করে বানিয়েছে কোলাজ। এ ছাড়া রয়েছে উত্তম-গৌরীর আসবাব...গোল ড্রেসিং টেবিল, চেস্ট অব ড্রয়ার... একাধিক আলমারি... তাদের পুরনো স্মৃতি ঐতিহ্য নিয়ে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে যেন আড্ডা-আলাপে মেতে নতুন আসবাবের সঙ্গে। ঠিক সেই সিনেমার মতো, যা ফিরে ফিরে যায় ফ্লাশব্যাকে। যে আসবাব হয়তো মুখ টিপে হাসে, গালে টোল ফেলে, চোখ টিপে মসকরা করে হয়তো জানায় অজানা আরও গল্প, যা এই বাড়ি ছেড়ে হাঁটা দেয় অন্য পথে। বলে— |
ও ভায়া, তোমরাই তা হলে বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি... |
উত্তমকুমারের অভিন্নহৃদয় ভাই-কাম- বন্ধু ছিলেন ডা. লালমোহন মুখোপাধ্যায় (লালু)। তাঁদের আড্ডা বসত ভবানীপুরের প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের লালমোহনের বড়দি বেলা মজুমদারের বাড়িতে। লালুর স্ত্রী, দেবীকে উত্তম বলতেন দেবীদা।
তো তখন একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। গৌরীদেবীর সঙ্গে উত্তমের মনোমালিন্য চলছে...আর যেহেতু দু’জনেই ওই বাড়ির আড্ডায় যোগ দিতেন, তাই সেই আগ্নেয় অবস্থায় এক জন এলেই বাকি সদস্যরা চিন্তায় পড়ে যেতেন...এই রে...
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। এক দিন উত্তম সবে ঢুকেছেন। এসেই উনি গাড়িটা ছেড়ে দিতেন, যাতে পাড়ার ছেলেরা জানতে না পারে... জানলে তো প্রলয় হয়ে যাবে! যাবার সময় টুক করে একটা ট্যাক্সিতে পাড়ি দিতেন। তো উনি যে এসেছেন গৌরী জানেন না...আবার গৌরী যে আসবেন উত্তম জানতেন না। হঠাৎ গৌরীর কণ্ঠস্বর শুনে ভিতরের ঘরে গিয়ে চুপিচুপি শুয়ে পড়েন উত্তম। বেশ কিছুক্ষণ উত্তমকে উপলক্ষ করেই টক-ঝাল-মিষ্টি নানা কথা চলে, আর ভিতর থেকে সব শুনে মিটিমিটি হাসেন উত্তম। শেষে গৌরী চলে যাওয়ার পরে উত্তম বেরিয়ে আসেন, তার পর কোমরে হাত দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন, “ও ভায়া তোমরাই তা হলে বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি!” আরব্যরজনীর মতোই এ সব গল্প অনন্ত।
সব শেষে একটা কথা খুব সঙ্কোচের সঙ্গে জানিয়ে রাখি, পারিবারিক আত্মীয়-বন্ধুতার কারণে জন্ম থেকে ওঁকে আমিও দেখেছি এবং আমার মা, মনিকার (বেলা মজুমদারের পুত্রবধূ) কাছে শুনেছি, আমি খুব ছোট বেলায়...সবে সবে কথা ফুটেছে আমার...ঠিক করে নিজের নামটাও উচ্চারণ করতে পারতাম না...তবুও ওঁর কোলে উঠে বলেছিলাম আশ্চর্য একটা শব্দ!
কী?
‘উত্তমকামার’।
পুনশ্চ: তখন কী বুঝেছিলাম, সত্যি সত্যিই স্যাকরার ঠুকঠাক তো কামারের এক ঘা! |
|
|
|
|
|