প্রকৃতির আর এক উলটপুরাণ বঙ্গের বর্ষণ-মানচিত্রেও!
ভরা মরসুমেও বর্ষার কৃপাদৃষ্টিতে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল। সেখানকার বিভিন্ন জেলার কোথাও কোথাও বৃষ্টির ঘাটতি ৪০% ছুঁয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বাঁকুড়া। যেখানে বৃষ্টির জন্য হাহাকার চিরকালের চেনা ছবি, সেই ‘শুখা’ জেলাটিতেই এ বার বর্ষার দাক্ষিণ্য সবচেয়ে বেশি! পশ্চিমাঞ্চলের বাকি সব জেলা যখন বৃষ্টির ঘাটতিতে ধুঁকছে, তখন বাঁকুড়া পেয়েছে অতিরিক্ত বর্ষণ!
আলিপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুর-বর্ধমান-বীরভূমে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টি হয়েছে অনেক কম। ঘাটতি সর্বোচ্চ পশ্চিম মেদিনীপুরে ৪২%। কিন্তু ঠিক পাশেই বাঁকুড়া জেলায় বৃষ্টিপাতের মাত্রা স্বাভাবিকের ৩২% বেশি!
শুধু পশ্চিমাঞ্চল নয়, বৃষ্টির নিরিখে এ বার তামাম দক্ষিণবঙ্গেই বাঁকুড়া উজ্জ্বল ব্যতিক্রম!
আবহ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাঁকুড়ার বৃষ্টির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, স্বাভাবিকের কম বৃষ্টি হওয়াটাই সেখানে রেওয়াজ। ২০১১-র জুনে অবশ্য বাঁকুড়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। তবে মৌসম ভবনের তথ্য বলছে, ওই বছর জুন মাসে গোটা দক্ষিণবঙ্গেই অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সে বার বাঁকুড়া ‘ব্যতিক্রম’ ছিল না। কিন্তু এ বছর যেখানে দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় বৃষ্টি কৃপণ, সেখানে বাঁকুড়ায় তা এত দরাজ হল কেন?
এর পিছনে মূলত তিনটি কারণকে দায়ী করছেন আবহবিদেরা। তাঁরা বলছেন, উল্লম্ব মেঘ, ঘূর্ণাবর্ত ও নিম্নচাপ-অক্ষরেখার ত্রিফলাতেই বাঁকুড়া ভেসেছে। মরসুমের সূচনা থেকে এই তিনটি ওখানে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। অর্থাৎ কখনও এর একটি বা দু’টি অনুপস্থিত থাকলেও তৃতীয়টি সক্রিয় থেকে বর্ষণের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ জানাচ্ছেন, জুন মাসে বাঁকুড়ার উপরে ঘন ঘন উল্লম্ব মেঘ তৈরি হয়েছিল। যার জেরে স্থানীয় ভাবে ভারী বৃষ্টি পেয়েছে ওই জেলা। গত জুনে উল্লম্ব মেঘ থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টির নজিরও রয়েছে বাঁকুড়ায়। আলিপুরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথও বলছেন, “স্থানীয় ভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টির দরুণ বাঁকুড়া অন্যান্য জেলার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে।”
এবং বাঁকুড়ার আকাশে উল্লম্ব মেঘের এ হেন ঘনঘটার পিছনে দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার সার্বিক দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন আবহ-বিজ্ঞানীদের অনেকে। তাঁদের দাবি: দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা দুর্বল হলে পশ্চিমাঞ্চলে স্থানীয় ভাবে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ে। এ বার সেটা হয়েছে শুধু বাঁকুড়ায়, এবং প্রবল ভাবে। এই মহলের ব্যাখ্যা: মৌসুমি বায়ু সক্রিয় না-থাকলে পশ্চিমাঞ্চলে উল্লম্ব মেঘ তৈরি হয়। তা থেকেই স্থানীয় ভাবে বৃষ্টি নামে। ঘটনাচক্রে এ বছর জুন-জুলাইয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় উল্লম্ব মেঘজনিত স্থানীয় বৃষ্টি তেমন না-হলেও বাঁকুড়ায় যথেষ্ট হয়েছে।
উপরন্তু বাঁকুড়া-ঝাড়খণ্ড সীমানায় অনেক বেশি ঘূর্ণাবর্তও তৈরি হয়েছে। তা উল্লম্ব মেঘ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে জোরদার করেছে। সঙ্গে জুড়েছে নিম্নচাপ-অক্ষরেখার প্রভাব। আলিপুরের খবর: চলতি মরসুমে নিম্নচাপ-অক্ষরেখার উত্তর-দক্ষিণে ওঠা-নামার প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণবঙ্গে বর্ষায় টান পড়েছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গ হোক বা দক্ষিণবঙ্গ অক্ষরেখা যে দিকেই ঝুঁকে থাকুক, বাঁকুড়ার উপরে তার অবস্থান ছিল মোটামুটি স্থির। বাঁকুড়ায় বর্ষার উপুরহস্ত হওয়ার পিছনে এরও ভূমিকা দেখছেন অনেকে। “গত সোমবার কলকাতা বাদে দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলায় সে ভাবে বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু তখনও বাঁকুড়ার উপরে নিম্নচাপ-অক্ষরেখা অবস্থান করছিল।” মন্তব্য এক আবহবিদের।
এ সবই হাতে হাত মিলিয়ে জোয়ার এনেছে বাঁকুড়ার বর্ষা-ভাগ্যে। অন্য দিকে বাকি দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি কম হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে ইতিমধ্যে উদ্বেগের ছায়া। কৃষি-সূত্রের খবর: গত মরসুমে এই সময়ে দক্ষিণবঙ্গে ১৯% ধান রোয়া হয়ে গিয়েছিল। এ বার হয়েছে ১৬%। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার ১ লক্ষ হেক্টর কম জমিতে চাষ হয়েছিল। এ বারও জুলাইয়ে বৃষ্টির ভাবগতিক দেখে কৃষি-কর্তারা গত ১৭ জুলাই দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার কৃষি-আধিকারিকদের ডেকে পাঠিয়ে সতর্ক করেছেন। চাষিদের বলা হয়েছে খেপে খেপে বীজতলা তৈরি করতে। জলের উৎসের কাছাকাছি যৌথ বীজতলা বানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ধানের বিকল্প হিসেবে কলাই, ভুট্টা ও মোটা দানার কালো সর্ষে চাষ করতে বলা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সেচের জন্য ডিভিসি’র জলের মুখাপেক্ষী হয়েছে সরকার। ডিভিসি-র চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ সেন জানিয়েছেন, রাজ্য প্রথম ধাপে এক লক্ষ কিউসেক জল চেয়েছে। গত ক’দিন ধরে বিভিন্ন জলাধার থেকে দৈনিক ৮-১০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হচ্ছে। রাজ্যের কৃষি-অধিকর্তা পরিতোষ ভট্টাচার্য অবশ্য সোমবার বলেন, “সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত খরিফ চাষের সুযোগ আছে। আশা করা যায়, তার মধ্যে বৃষ্টির ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে।”
|