একাদশ শ্রেণির আটটি পাঠ্যবই প্রকাশ ও বিক্রির উপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিল কলকাতা হাইকোর্ট। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ যে-দু’টি প্রকাশনা সংস্থাকে ওই আটটি বই প্রকাশ, সরবরাহ ও বিক্রির দায়িত্ব দিয়েছিল, তারাই তা করবে। কোর্টে জট কাটলেও বাইরে সংসদ-প্রধানের কিছু মন্তব্য ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কিছু পর্যবেক্ষণ আছে হাইকোর্টেরও। বইগুলির জন্য দরপত্রের প্রক্রিয়ায় সরকার যে-ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে, তা আপাত ভাবে ঠিক নয় বলে মনে করছে তারা। আইন অনুযায়ী সংসদের কাজে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে ঠিকই। কিন্তু ওই দরপত্রের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের পর্যাপ্ত কারণ ছিল না বলেই সংসদের নথিপত্র দেখে প্রাথমিক ভাবে ধারণা হয়েছে আদালতের। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ১৫ দিনের মধ্যে সংসদ এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় যোগ দেওয়া সব প্রকাশন সংস্থাকে হলফনামা পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাত দিনের মধ্যে আবেদনকারী প্রকাশনা সংস্থা হলফনামার উত্তর দেবে। মামলাটির শুনানি হবে সেপ্টেম্বরে।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু হাইকোর্টের এ দিনের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, “পড়ুয়াদের বই পাওয়ার বাধা কাটায় আমরা খুশি। তবে হাইকোর্ট ওই মামলায় আর কী বলেছে, রায় না-দেখে সেই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।”
সংসদের পক্ষে আইনজীবী এক্রামুল বারি এ দিন বলেন, প্রকাশন সংস্থা বাছাইয়ের জন্য সংসদের ১৪টি মাপকাঠি রয়েছে। সংসদের প্রকাশনা বিষয়ক সাব-কমিটি সেই সব মাপকাঠির বিচারে ১৬ মে একাদশ শ্রেণির আটটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সাতটি একটি সংস্থাকে এবং অন্য একটি সংস্থাকে একটি বইয়ের বরাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। |
সংসদের আইনজীবী জানান, তার পরেই, ২৯ মে রাজ্য সরকারের পক্ষে স্কুলশিক্ষা দফতরের সচিব সংসদকে চিঠি দিয়ে জানান, ওই দরপত্রের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু অভিযোগ উঠেছে। তাই আবার দরপত্র চাওয়া দরকার। সরকার অসীম রায়, টি কে অধিকারী এবং এম এম মহসিন তিন পর্যবেক্ষককে সংসদে পাঠায়। পর্যবেক্ষকদের সুপারিশে ফের দরপত্র চাওয়া হয়। এ বার দু’টির জায়গায় বরাত দেওয়া হয় চারটি প্রকাশন সংস্থাকে। সেই বই ছাপা হয়ে বিক্রির জন্য বাজারে আসার মুখে বরাত না-পাওয়া একটি সংস্থা মামলা করে হাইকোর্টে। উচ্চ আদালত বই ছাপা ও বিক্রির উপরে স্থগিতাদেশ দেয়।
বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেন। সংসদের দরপত্র সাব-কমিটি ১৬ মে যে-দু’টি প্রকাশন সংস্থাকে বরাত দিয়েছিল, তারাই বই সরবরাহ ও বিক্রি করতে পারবে। সরকারের হস্তক্ষেপের জন্যই পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে আপাত ভাবে মনে করেছে হাইকোর্ট।
মামলার শুনানি শেষ হওয়ার পরে সংসদ-সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের বই পাওয়ার জটিলতা কাটল। তিনটি বইয়ের ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা রয়েছে। সেগুলি হল বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের জন্য পরিবেশবিদ্যা এবং সংস্কৃত বই। সেগুলি পড়ুয়াদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিকেই এখন অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
সরকারি ভাবে এই প্রতিক্রিয়া জানানোর পরে হাইকোর্টের অলিন্দে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মুক্তিবাবু এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যাকে ঘিরে নতুন বিতর্ক দানা বেঁধেছে। তাঁর কথায়, “সাংবাদিক বৈঠক করে এ বার আমি সব বলব।” এখানেই থেমে যাননি তিনি। সংসদ-সভাপতি বলেন, “সত্যেরই জয় হয়। আমি যে-কোনও তদন্তের মুখোমুখি হতে রাজি। আমার কিছু হারানোর নেই। পদের কোনও মোহ নেই। আমি ছাত্রদরদি শিক্ষক। তাই ছাত্রদের স্বার্থে যা করার করব।’’
বইয়ের দরপত্র সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের পর্যবেক্ষকদল গড়ে দেওয়াটা যে মুক্তিবাবু ভাল ভাবে নেননি, এ দিন হাইকোর্টের অলিন্দে তাঁর বিভিন্ন মন্তব্যে তার ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করছেন সংসদের অনেকেই। সংসদ-সভাপতি সেখানে এমনও মন্তব্য করেন যে, পদে কী আছে? একটা গাড়ি, একটা মোবাইল আর বিকাশ ভবনের লিফটে চড়া! স্কুলশিক্ষা সচিবের তিন দিন ধৈর্য ধরেনি। সকলে জানতেন, আমার চোখের অপারেশন হবে। তিন দিন পরে কাজে ফিরব। তার মধ্যেই এ-সব হল। আমার অপারেশনের সুযোগ নিয়ে আমার সচিব এ-সব করেছে। সংসদ ব্যবসা করে না। সংসদ প্রথম থেকে বলেছে, রয়্যালটি একমাত্র মাপকাঠি নয়। সমস্ত মাপকাঠি খতিয়ে দেখে যা ঠিক, তা-ই করা হয়েছে।
তাঁর উপরে কি এ বার সরকারের দিক থেকে চাপ আসবে?
মুক্তিবাবু বলেন, “ও-সব চাপে আমি ভীত নই। আমার কোনও মোহ নেই। পেটে বিদ্যে আছে। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে বসলেও উপার্জন করতে পারব। এ বার আমি সব বলব।” সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, যে-প্রকাশনা সংস্থা মামলা করেছে, পাঠ্যপুস্তক ছাপার অভিজ্ঞতা তাদের তেমন নেই। এত বই কারা সময়মতো সরবরাহ করতে পারবে, কাদের কেমন পরিকাঠামো আছে এ-সব বিবেচনা করতে হয়।
আদালত কক্ষের বাইরে তাঁর এই সব মন্তব্যের ব্যাপারে রাতে যোগাযোগ করা হলে মুক্তিবাবু বলেন, “ঘনিষ্ঠ মহলে আমি আমার মনের কথা বলেছি। সকলের জন্য নয়।”
তত ক্ষণে অবশ্য মুক্তিবাবুর মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। সংসদের সচিব অচিন্ত্য পাল বলেন, “ওঁর যা মনে হয়েছে, তা-ই বলেছেন। সংসদের সচিব হিসেবে আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী সরকারের কাছে একটি নোট পাঠিয়েছিলাম। এখনও মনে করি, কাজটা ঠিকই করেছি। তা না-হলে কি জল এত দূর গড়াত?”
সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “হাইকোর্টের অলিন্দে মুক্তিবাবু কী বলেছেন, আমি তো শুনিনি। উনি আমাকে জানিয়েছেন, এ-সব কথা বলেননি। উনি দায়িত্বশীল পদে আছেন। ওঁর কথায় আস্থা রাখছি।”
|