গত তিন বারের তুলনায় সোমবার চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অনেক বেশি সক্রিয় উপস্থিতি দেখল চার জেলা। নদিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও মালদহ এই চার জেলাতেই সন্ত্রাসের আশঙ্কা করছিলেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। বিশেষ করে গত কয়েক দিন তেতে থাকা বীরভূম এবং ঐতিহ্যগত ভাবেই পঞ্চায়েত ভোটে রক্তাক্ত হওয়া মুর্শিদাবাদে। রবিবার রাত থেকে বিভিন্ন ঘটনায় ৭ জন মারা গেলেও ভোটের দিন হিংসা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে বলে পুলিশ কর্তাদের মত।
পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখার কৃতিত্ব জেলা প্রশাসনগুলি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিলেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে কিন্তু এ দিন তাদের অতি সক্রিয়তা নিয়ে সরব হয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বাড়াবাড়ির জেরে চতুর্থ দফায় অনেকেই ভোট দিতে পারেননি।
এ দিন মালদহের রতুয়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে এক জনের মৃত্যু হয়। ওই জেলারই বৈষ্ণবনগর থানার রামেশ্বরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫ নম্বর বুথে লাঠি চালায় বাহিনী। রতুয়ায় কংগ্রেস প্রার্থী বুথের ভিতরে প্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা বাধা দিলে দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। জওয়ানরা গুলি চালালে এক কংগ্রেস কর্মী মারা যান। আর রামেশ্বরপুরে এ দিন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ লাঠি চালায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। বুথের কাছে থাকা বছর দশেকের এক বালক পালাতে গিয়ে গরম তেলের কড়াইতে পড়ে যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর পর উত্তেজিত জনতা বিডিও এবং পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে। |
রামেশ্বরপুরের ঘটনা নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই কারণেই তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের বিরোধী ছিলেন। বহিরাগত এই বাহিনীর জওয়ানদের এলাকা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। সামান্য গন্ডগোল দেখলেই তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তার ফলেই এমন ঘটনা ঘটে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাজ্য পুলিশই পরিস্থিতি অনেক ভাল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। মমতার ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, এ দিন উত্তরবঙ্গ থেকেই ফোনে তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর বাড়াবাড়ি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে অভিযোগ জানাতে মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ কর্তারা অবশ্য বলছেন, গত তিন দফা ভোটের মতো এ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রাখা হয়নি বলেই অন্যান্য বারের পঞ্চায়েত ভোটের তুলনায় হানাহানি অনেক কম হয়েছে। সরকারি হিসেবে এ দিন দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। রতুয়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে এক জন ছাড়াও মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় বোমার ঘায়ে মারা যান এক মহিলা। পুলিশ জানিয়েছে, রবিবার, ভোটের আগের রাতে বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে বোমা বাঁধতে গিয়ে দুই যুবকের মৃত্যু হয়। মুর্শিদাবাদের রানিনগর ও নদিয়ার মায়াপুরেও একই ভাবে বিস্ফোরণে মারা যান তিন জন। ওই রাতেই বীরভূমের পাড়ুই থানার কসবায় এক নির্দল প্রার্থীর বাবাকে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তুলনায় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে মুর্শিদাবাদেই সব মিলিয়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল (তার মধ্যে শুধু ডোমকলেই ১৩ জন) বলে জানাচ্ছেন পুলিশ কর্তারা।
শুধু সক্রিয় উপস্থিতি নয়, এ দিনের ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যাও বেশি ছিল। পুলিশের তথ্য বলছে, গত তিন দফায় যেখানে ভোটের দিন সর্বোচ্চ ২৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, এ দিন তার সঙ্গে আরও ৩০ কোম্পানি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। মালদহে ৫৭, নদিয়ায় ৬০, বীরভূমে ৭৫ এবং মুর্শিদাবাদে ৯৩ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। |
এই বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন এবং তাদের দৃশ্যমানতা সম্পর্কে বিরোধীদের একাংশের ব্যাখ্যা, এই দফায় যেখানে ভোট, সেখানে তৃণমূলের জোর তেমন বেশি নয়। মুর্শিদাবাদ রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর গড়। মালদহ জেলা পরিষদ কংগ্রেসের দখলে রয়েছে। বীরভূমে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে দীর্ণ তৃণমূল। একমাত্র ব্যতিক্রম নদিয়া। তাঁদের অভিযোগ, তৃণমূল নিজেদের এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পুলিশ লাইন, সেক্টর অফিসে আটকে রেখে ইচ্ছে মতো ভোট করেছে। আর এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের দমন করার চেষ্টা করেছে।
তৃণমূল নেতারা অবশ্য এ দিন অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছেন কংগ্রেস নেতারাই। মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিরক্ত বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা। আর মমতা নিজে বলেছেন, “এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে, রেলের ফোর্স নিয়ে জনগণকে ভয় দেখিয়েছেন। মানুষের প্রতি বিশ্বাস থাকলে কেন বোমাবাজি করলেন? কেন বন্দুক ধরলেন?”
অধীর চৌধুরী অবশ্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, “হিংসা যত কম হয়, সেই চেষ্টাই করেছেন জওয়ানরা। তৃণমূল ভোট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী তাদের ভূমিকা পালন করায় তা সম্ভব হয়নি।”
কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তাঁরাই ব্যবহার করেছেন তৃণমূলের এই অভিযোগ মানতে চাননি কংগ্রেস নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, স্থানীয় ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকে ‘সেকেন্ডারি ফোর্স’ হিসেবে। রাজ্য প্রশাসনের নির্দেশেই তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়। লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রে যা উল্টো। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার কথায়, “প্রথম তিন দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনী যখন চোখে পড়ল না, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল পুলিশ সুপার এবং জেলাশাসকদের হাতে। চতুর্থ দফায় মালদহ, মুর্শিদাবাদে যখন তাদের একটু বেশি করে চোখে পড়ল, তখনও নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতেই। তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিকে মুখ্যমন্ত্রী আঙুল তুলছেন কী করে?” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই অভিযোগকারী আবার নিজেই কাজি! অথচ গোলমাল যা হয়েছে, তার জন্য মূল অভিযুক্ত তিনিই!”
তৃণমূল নেতাদের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, ভোট চলাকালীন ডিএম, এসপি-রা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও ওঁদেরই। তা হলে রাজ্য সরকারের উপর দায় চাপানো হচ্ছে কেন? আধা-সামরিক বাহিনীর গুলিচালনায় রতুয়ায় এক জনের মৃত্যুর জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও বিরোধী দলগুলিকেও দায়ী করে তৃণমূল মুখপাত্র ও সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, মাননীয় আদালত এবং আরও অনেকে (নির্বাচন কমিশন) বলেছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী এলে ভোট শান্তিপূর্ণ হবে! কিন্তু এখন এদের গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিচ্ছে? এর দায় কে নেবে?” |
প্রশাসনের কর্তারা অবশ্য বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এবং তাতে ফল ভালই হয়েছে। যেমন, ডোমকল মহকুমায় পাঠানো হয়েছিল ১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। তারা সকাল থেকেই কার্যত বুথ ও ভোটের লাইনের দখল নিয়ে নেয়। কুপিলায় একটি বুথের সামনে এক যুবক মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন। এক জওয়ান মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলেন, “এখানে এ সব চলবে না।” রঘুনাথগঞ্জ-১ ব্লকের দফরপুর পঞ্চায়েতের রমাকান্তপুরে সিপিএম কর্মী নইমুদ্দিন শেখ দলের টোকেন বিলি করছিলেন ভোটারদের মধ্যে। টহলরত বাহিনী তা দেখতে পেয়ে তাঁকে বেধড়ক পেটায়। নইমুদ্দিনের হাত ভেঙে যায়। তাঁকে জঙ্গিপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয়তার ছবি ছিল গোটা মুর্শিদাবাদ জুড়েই। বহরমপুরের শ্রীগুরু পাঠশালায় দীর্ঘ লাইন সামান্য বেঁকে গেলেই লাঠি উঁচিয়ে তা সোজা করে দিয়েছেন জওয়ানরা। গজধরপাড়ার বুথে সকাল থেকেই ভিড় করেছিলেন কংগ্রেস ও তৃণমূলের কর্মীরা। বেশ ক’বার বারণ করা সত্ত্বেও ভিড় হালকা হচ্ছে না দেখে শেষ পর্যন্ত লাঠিপেটা করে দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের সরিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। বস্তুত, দিনভর ভোটের লাইনের আশপাশে ভোটার ছাড়া কাউকেই রেয়াত করেনি তারা।
শাসক দলের কর্মীরা এজেন্ট দিতে পারছে না বলে গণ্ডগোল দানা বাঁধছিল ভরতপুরের গীতগ্রামে। জওয়ানরা তাঁদের বহু বার সরতে বলেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় সেক্টর অফিস থেকে জনা ত্রিশ জওয়ান এসে লাঠি চালিয়ে নিমেষে এলাকা ফাঁকা করে দেন। এখানে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতাকে বলতে শোনা যায়, “এ তো হিতে বিপরীত হল। শাসক-বিরোধী কাউকেই মানছে না জওয়ানরা।”
|