যেন দু’টি হাতই কাটা গিয়েছে!
দীর্ঘদিনের এক সেনাপতি এখন বিরোধী শিবিরে। হাজতে অন্য সেনাপতি। এই প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে ভোটের ময়দান ছেড়ে চলে গেলেন রেজ্জাক মোল্লা। ভোট চলাকালীন দলের কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে পাশে পেলেন না।
আর দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পাশে থাকতে গিয়ে বুথে ঢুকে সিআরপি-র মার খেলেন ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম।
বছরের গোড়া থেকে দু’পক্ষের দুই নেতার নানা চাপান-উতোরে সরগরম দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-ভাঙড় এলাকা। দুই নেতাই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও তুলেছিলেন। শুক্রবার, ভোটের দিন দুই নেতাই যেন কিছুটা ম্রিয়মান! |
এ দিন সকাল সাড়ে ন’টায় ক্যানিংয়ের বাঁকড়ি গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভোট দিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ কলকাতা রওনা দেন রেজ্জাক। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “ভাঙড়ের দু’টি এবং ক্যানিংয়ের দু’টি ব্লকের ৯৯ শতাংশ বুথই তৃণমূল দখল করে নিয়েছে। এখানে থেকে কী করব? আমার উপরে প্রাণঘাতী হামলা হতে পারে, এমন একটা গন্ধ পাচ্ছি। সুব্রত মুখোপাধ্যায় (পঞ্চায়েত মন্ত্রী) ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপদেই ভোট দিলাম।”
গ্রামবাসী এবং সিপিএমের একাংশ কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাঁদের মতে, রেজ্জাকের ‘দুই হাত’ সওকৎ মোল্লা এবং সাত্তার মোল্লা না থাকাতেই এ বার তিনি অনেকটা ম্রিয়মান। ক্যানিংয়ে রেজ্জাকের দীর্ঘদিনের সেনাপতি ছিলেন সওকৎ। দল পাল্টে এখন তিনি তৃণমূলের ক্যানিং-২ ব্লক সভাপতি। আর ভাঙড়ের সাত্তার মোল্লা তৃণমূল কর্মী খুনের অভিযোগে জেল-হাজতে।
ভোটের ময়দান থেকে এত দ্রুত চলে যেতে রেজ্জাককে আগে কখনও দেখা যায়নি। বিধানসভা লোকসভা বা পঞ্চায়েত স্তরের নির্বাচন ভোটের দিন ক্যানিং-ভাঙড় এলাকায় রেজ্জাক মোল্লা বরাবর সামনে থেকে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জীবনতলা বা ক্যানিংয়ে দলীয় কার্যালয়ে তিনি বসে থাকতেন। হয়তো গলায় গামছা থাকত, গায়ে ফতুয়া। কিন্তু ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতেন এই এলাকার তিনিই ‘বেতাজ বাদশা’।
বাম আমলে বিভিন্ন নির্বাচনে সওকৎ-সাত্তারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা দলীয় কর্মী-সমর্থকদের খুন, হুমকি, বাড়ি গিয়ে শাসানি এবং ভোটের দিন তাদের এজেন্টদের মারধরের অভিযোগ তুলতেন। রেজ্জাক কোনও দিনই সে সব পাত্তা দেননি। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মাসখানেক পরেই সওকৎ দল পাল্টে যোগ দেন তৃণমূলে। রেজ্জাকের ভরসা ছিলেন দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাত্তার মোল্লা। কিন্তু এক তৃণমূল কর্মীকে খুনের অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ফলে, ভোটের শেষ দিনের প্রচার এবং ভোটের দিন তাঁকে পাশে পেলেন না রেজ্জাক। |
গলায় গামছা, গায়ে ফতুয়া পরে শুক্রবার কয়েক জন দলীয় কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে হেঁটেই বাড়ির পাশের বাঁকড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোট দিতে যান রেজ্জাক। তিনি বেরোবার সময়ে বুথের সামনেই তৃণমূল ও সিপিএম সমর্থকদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। সিপিএম সমর্থকেরা এ নিয়ে রেজ্জাকের কাছে অভিযোগ জানাতে এলে তিনি বলেন, “ওদের যদি পাল্টা মারতে না পার, তা হলে বাড়ি চলে যাও।”
সওকৎ-সাত্তার পাশে না-থাকাতেই কি এ বার এক ঘণ্টার মধ্যে ভোটের ময়দান ছাড়লেন?
সরাসরি উত্তর দেননি রেজ্জাক। শুধু বলেন, “সাত্তার তো হাজতে। ও পাশে থাকবে কী করে? হাত না থাকলে আর কী করব? মানুষ যা বুঝবেন, তাই করবে।” আর সওকতের নাম না নিয়ে তাঁর কটাক্ষ, “দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন অনেক মধ্যবিত্ত ধান্দাবাজ আমাদের দলে এসেছিল। তাদের দৌরাত্ম্যে অনেক গরিব মানুষই সিপিএমের উপরে বিরূপ হয়ে তৃণমূলকে সমর্থন করছেন। ধান্দাবাজগুলোও তৃণমূলে চলে গিয়েছে।” সওকৎ দাবি করেছেন, “রেজ্জাক সাহেব কখনই সংগঠন দেখতেন না। সিপিএমে থাকার সময়ে আমিই তা দেখতাম। এখন রেজ্জাক সাহেব ভরসা পাবেন কী করে?”
আরাবুলের এ দিন ভোট দেওয়ার কথা ছিল না। তিনি আগেই জিতে গিয়েছেন। এ দিন তিনি ভাঙড়-২ ব্লকের কুলবেড়িয়া বুথে যান। কিন্তু সেখানে ঢোকার অনুমতি না থাকায় সিআরপি তাঁকে লাঠি দিয়ে মেরে বের করে দেয়। আরাবুল বলেন, “সিপিএম ওই বুথ দখল করার চেষ্টা করছিল। তাই এক সহকর্মীকে নিয়ে সেখানে যাই দলের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে। ওখানে আমাকে হেনস্থার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি।”
|