পাখির চোখ ন্যায়বিচার, ভোটে মন নেই কামদুনির
কামদুনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটের বুথ থেকে তাঁদের বাড়িটা বড়জোর দেড়শো মিটার। তবু বিকেল গড়িয়ে গেলেও মৌসুমী কয়াল ওই দূরত্বটুকু পার হওয়ার চেষ্টা করলেন না।
শুক্রবার দিনভর নিঃশব্দে ঘরকন্নার কাজেই ডুবে থাকলেন তিনি।
পাশের বাড়ির টুম্পা কয়ালেরও গ্রামের ত্রিসীমানায় দেখা নেই। কামদুনির ভোটার তালিকায় তাঁর নাম থাকলেও সারা দিন নিউ টাউনে শ্বশুরবাড়ির গ্রাম আকন্দকিশোরীতে বসে কাটিয়ে দিলেন টুম্পাও।
প্রতিবাদের মুখ হয়ে ওঠা কামদুনির দুই কন্যাই ভোট থেকে সরে থাকার সিদ্ধান্তের পিছনে একটি কারণের কথা বলেছেন। মৌসুমীর কথায়, “কী করে ভোট দিই বলুন তো! আমাদের বন্ধু ওই মেয়েটার মা-বাবা কি পারছেন ভোটটা দিতে? ওঁরা যখন সুবিচারের আশায় হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে, তখন আমার পক্ষে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না!” একই কথা বলেছেন টুম্পাও। “এ বারই প্রথম ভোটের তালিকায় নাম উঠেছিল। খুব ইচ্ছে ছিল ভোটটা দেওয়ার। কিন্তু মাস দেড়েক আগের ঘটনাটাই সব ওলোটপালট করে দিল।”
গত ৭ জুন খুন হয়ে যাওয়া কলেজছাত্রীটির নাম এ বারেও ভোটার লিস্টে ছিল না। ঘটনাটা না-ঘটলে এই পঞ্চায়েত ভোটে তিনি নেহাতই অকিঞ্চিৎকর একটি চরিত্র হয়ে থাকতেন। বড়জোর মা-বাবার সঙ্গে গাঁয়ের সবেধন নীলমণি পাকা রাস্তাটা ধরে স্কুলবাড়িতে ভোট দেখতে যেতেন। এ দিন দেখা গেল, সেই মেয়েটিই তাঁদের গ্রামে ভোট হওয়া না-হওয়ার নেপথ্যে অদৃশ্য নির্ণায়ক হয়ে উঠেছেন। একটি মৃত্যুর অভিঘাতে কামদুনির বেশির ভাগ মানুষই ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, বিকেল পাঁচটায় ভোট শেষ পর্যন্ত কামদুনির ৯৫২ জন ভোটারের মধ্যে সাকুল্যে ২৬৫ জনের ভোট পড়েছে।
সুনসান ভোটকেন্দ্র। চলছে আধাসেনার নজরদারি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
কয়ালপাড়া, মণ্ডলপাড়া, ঘোষপাড়ায় বাড়ি-বাড়ি মহিলামহলে ভোটের কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখ ঝামটা শুনতে হয়েছে। ‘‘আপনাদের এত ভোট-ভোট বাতিক কেন বলুন তো! আমাদের এখন ন্যায় বিচার ছাড়া কিছু মাথায় নেই!’’ তরুণ সঙ্ঘের ক্লাবঘরে টিভি-তে ভোটের খবর দেখতে দেখতে কলেজপড়ুয়া অভিজিৎ-বিনয়দের ঠাট্টা: “আমাদের সব মাওবাদী-সিপিএম বলা হয়েছিল না? এ বার যোগ্য জবাব দিয়েছি!” টুম্পা বাড়ি ছিলেন না। তাঁর পরিজনেরা বুথের ছায়া মাড়াননি। কড়াই-খুন্তির টুংটাংয়ের ফাঁকে মুখ তুলে মৌসুমী বলেছেন, “লিখে রাখুন, আমরা কোনও পার্টি বা ধর্মের রং দেখি না! দোষীদের সব থেকে কড়া শাস্তি চাই। তবেই ফের কোনও দিন ভোট দেব।”
প্রতিবাদের জোয়ারে কামদুনির নাম এখন খাস রাষ্ট্রপতি ভবন অবধি পৌঁছে গিয়েছে। ফলে ওই তল্লাটে সুষ্ঠু ভাবে ভোট করাতে চেষ্টার কসুর করেনি প্রশাসন। কামদুনির একমাত্র ভোটগ্রহণ কেন্দ্রটিতে আধাসামরিক বাহিনীর ১২ জনের একটি আস্ত সেকশন মোতায়েন করা হয়। ধর্ষণের ঘটনার পরই গ্রামে পুলিশি শিবির বসেছিল। নির্বাচন কমিশনের আধিকারিক, পর্যবেক্ষক বা আধাসামরিক বাহিনীর টহল দিনভর লেগেই ছিল। কিন্তু বেলা অবধি ভোটারদেরই সে ভাবে দেখা গেল না।
এমন ‘আজিব ভোট’ দেখে থ হয়ে রইলেন সিআরপি-র ৪১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সেপাই, বিহারের রোহতাসের যুবক ধীরজ কুমার। “কই ভোটারের লাইন তো চোখে পড়ছে না! এ যে দেখি শুধুই টিভিওয়ালাদের ভিড়। বর্ধমানে তো এ সব দেখিনি!” তাঁর বাঙালি সহকর্মী, পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের পল্টু শীল ইশারায় ধীরজকে চুপ করে যেতে বললেন।
শাসক দলের নেতাদের তরফে অবশ্য তৎপরতার অন্ত ছিল না। বিধানসভা ভোটে কামদুনিতে তৃণমূলই কিছুটা ‘লিড’ পেয়েছিল। কীর্তিপুর-২ অঞ্চলের গ্রামসভা বা পঞ্চায়েত সমিতিতে বিরোধীরা এ বার প্রার্থী দিতে পারেননি। লড়াই বলতে শুধু জেলা পরিষদে। তা-ও বুথে বিরোধীদের পোলিং এজেন্ট নেই। তবু মুষ্টিমেয় ভোটারদের বুথে আনতে সাধ্যসাধনা করতে হয়েছে।
গ্রামসভায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী নীলিমা নস্করও কামদুনির বধূ। তাঁর ভাসুর ভেড়ির ব্যবসায়ী গৌতম নস্কর অন্যতম পোলিং এজেন্ট। তিনিও মানলেন, ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষতের জেরেই এ বার অনেকে ভোট দিতে আসেননি। তাতে অবশ্য এক দিক দিয়ে তৃণমূলের ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার পথই প্রশস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন গৌতমবাবু। তাঁর দাবি, ভোট যা পড়েছে তৃণমূলের পক্ষেই পড়েছে। কিন্তু প্রার্থীদের নাম লেখা স্লিপ ধরানোর সময়েও ধর্ষণ মামলায় দুর্বল পুলিশি তদন্ত নিয়ে অভিযোগ শুনতে হয়েছে তৃণমূল নেতাদের।
ভোট যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকে নানা আশঙ্কাও উগরে দিয়েছেন। এক মহিলা যেমন বলেছেন, তিনি সল্টলেকে আয়ার কাজ করতে যান। ধর্ষিতা তরুণী যে পথ ধরে ফিরছিলেন, ভেড়ির ধারের ওই নির্জন রাস্তা দিয়েই তাঁকে রোজ ফিরতে হয়। তাই ‘বিদ্রোহ করে ঝুঁকি’ নিতে চান না। ভোট দিয়েছেন ওই অঞ্চলের প্রাক্তন উপপ্রধান অঞ্জলি কয়ালও, গত পঞ্চায়েত ভোটে যিনি সিপিএমের টিকিটে জিতেছিলেন। অঞ্জলিদেবী বললেন, “বিশ্বাস করুন, আমি ভোটটা তৃণমূলকেই এ বার দিয়েছি। পারলে সবাইকে দেখাতাম!” পাশ থেকে এক প্রতিবেশীর অস্ফুট মন্তব্য, “ভোট না-দিয়ে উপায় আছে! ওদের দোকান ভেঙে দিলে খাবেটা কী!”
ভোট দেওয়া না-দেওয়ার জল্পনার মধ্যে একটি পরিবার সব কিছুর বাইরে এক কোণে পড়ে থাকল। ধর্ষিতা তরুণীর স্কুলপড়ুয়া ভাই সাতসকালে পড়তে চলে গেল। দাদা কয়েক জন পড়শি-বন্ধুর সঙ্গে হাইকোর্টে মামলা শুনতে কলকাতা গেলেন। প্রায়ান্ধকার ঘরে ক্ষয়াটে চেহারার এক প্রৌঢ় দম্পতি শুধু অবেলায় বিছানায় পড়ে। কন্যাহারা বাবার কাজে যাওয়া বন্ধ। তিনি বলে চলেছেন, “আর দু’বছর বাদে আমার মেয়েটা চাকরি করত। কী বুদ্ধি ছিল ওর! রাক্ষসেরা খেয়ে ফেলল গো!” মেয়ের মা আর রাঁধতে পারেন না। পড়শিরাই দু’টি ভাত ফুটিয়ে দেন। তিনি নাগাড়ে কাঁদেন, “কীসের ভোট? কোথায় বিচার! এর থেকে আমাদের দু’টি প্রাণীকে মেরে ফেললেই তো জ্বালা জুড়োত!”
ভোটের কোলাহল ভাঙা ঘরে পৌঁছয় না!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.