বৃহস্পতিবার থেকেই তাণ্ডব চলছিল এলাকায়। বাড়ি, গাড়ি, ভোটকেন্দ্রে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর সঙ্গে বোমা ছোড়া হয়েছিল খোদ ওসি-র গাড়িতে। আক্রান্ত হয়েছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক পর্যবেক্ষকও। কিন্তু এর পরেও আমডাঙায় পুলিশ-প্রশাসন যে কার্যত কোনও সতর্কতাই নেয়নি, শুক্রবার তার প্রমাণ মিলল হাতেনাতে। ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে বোমার ঘায়ে মারা গেলেন ৬০ বছরের মাদারবক্স মল্লিক। তিনি সিপিএম সমর্থক বলে তাঁর পরিবারের দাবি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শুধু বোমা ছুড়েই থামেনি দুষ্কৃতীরা। এলাকায় আতঙ্ক ছড়াতে শুরু হয় গুলিবৃষ্টি। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং কমব্যাট ফোর্স নিয়েও গ্রামে ঢুকতে পারেননি পুলিশকর্তারা। শেষ পর্যন্ত বেশি রাতে গ্রামের কাছের রাস্তায় বাহিনী টহল দিলেও গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামে তারা ঢোকেনি। উত্তেজনা যাতে আর না-বাড়ে সে জন্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে বাহিনীকে গ্রামে ঢুকতে বারণ করে সংযত থাকতে বলা হয়েছে বলেই পুলিশ সূত্রের খবর।
শুক্রবার তৃতীয় দফার ভোট নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিল পুলিশ প্রশাসন। আর এ পর্যন্ত ভোটের দিন সব চেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটল এই দফাতেই। প্রথম দফার ভোটে কারও মৃত্যু হয়নি। দ্বিতীয় দফায় মারা গিয়েছিলেন তিন জন। শুক্রবার বেলা যত গড়িয়েছে, ততই এসেছে মৃত্যুর খবর। রাতে গিয়ে দেখা যায় মৃতের সংখ্যা পাঁচ। তিন দফা ভোটের পরে সব মিলিয়ে মারা গেলেন আট জন। |
আমডাঙার বোদাই পঞ্চায়েতের টেঙাটেঙি গ্রামের ঘটনাটি ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনায় এ দিন মারা গিয়েছেন আরও এক জন। দেগঙ্গায় শেখ আনোয়ার হোসেন (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে। কংগ্রেসের দাবি, নিহত ব্যক্তি তাদের সমর্থক। পাশের জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মারা গিয়েছেন তিন জন। তাঁদের মধ্যে লক্ষ্মীকান্তপুরের সনৎ ঘোষ (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে খুন করা হয়। সনৎবাবু তাঁদের কর্মী বলে দাবি করেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। রাত আটটা নাগাদ জয়নগরের মায়াহাউড়িতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহত হন অমল হালদার (৩২) নামে এক যুবক। এসইউসি-র দাবি, অমল তাদের কর্মী। ক্যানিংয়ের জীবনতলায় তৃণমূলের পতাকা ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগে সোমনাথ মুখোপাধ্যায় (১৬) নামে এক কিশোরকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। পরিবারের দাবি, সোমনাথ মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।
এ দিন সকাল থেকেই তিনটি জেলার বিভিন্ন জায়গায় বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে গভীর রাত পর্যন্ত তিনটি জেলায় ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। বিক্ষিপ্ত গোলমাল হয়েছে হাওড়ার পাঁচলা, বাগনান-সহ বিভিন্ন এলাকায়। একই অভিযোগ এসেছে দুই ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকা থেকে। তবে গোলমালের নিরিখে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে আমডাঙা।
কী হয়েছে সেখানে?
সকাল আটটা। তত ক্ষণে প্রায় ১০০টি ভোট পড়ে গিয়েছে টেঙাটেঙির বুথে। হঠাৎই পাহারায় থাকা দুই সশস্ত্র পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বুথে ঢুকে পড়ে পড়ে এক দল দুষ্কৃতী। ভোটকর্মীদের ধাক্কা দিয়ে তারা ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশকর্মীরা বাধা দিলে তাঁদের এক জনের হাতে চপারের কোপ মারা হয়। অন্য জনের মাথায় রডের ঘা পড়ে। এর পরে বিনা প্রতিরোধেই তিনটি ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে পাশের পুকুরে ফেলে দেয় হামলাকারীরা।
ভোটের লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা প্রতিবাদ করলে দুষ্কৃতীরা শূন্যে গুলি চালায়। শুরু হয় বোমাবাজি। পুলিশের গাড়ি লক্ষ করেও বোমা ছোড়া হয়। এরই মধ্যে ভোট দিতে আসা মাদারবক্স মল্লিকের মাথায় বোমা লাগে। পরে বারাসত জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাঁর ছেলে মহম্মদ কাসেম আলি মল্লিকের অভিযোগ, তৃণমূলের দুষ্কৃতীরাই খুন করেছে তাঁর বাবাকে। তিনি বলেন, “আমি গ্রামে নিজের দোকানে ছিলাম। বাবা বোমার ঘায়ে জখম হয়েছেন শুনেও দুষ্কৃতীদের
গুলিবৃষ্টির দাপটে এলাকায় ঢুকতে পারিনি।” জেলার সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্যও বলেন, “আমডাঙার বিভিন্ন বুথে রিগিং করেছে তৃণমূল। বোমা-গুলি নিয়ে হামলা করেছে। বহু বাড়ি ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমাদের এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বোমায়।”
আমডাঙার তৃণমূল বিধায়ক রফিকুল রহমানের পাল্টা অভিযোগ, “পুলিশের হাতে যত অস্ত্র, তার থেকে বেশি অস্ত্র ঢুকেছে গ্রামে। পুলিশের সাহায্যে নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে সিপিএমের লোকরা। আমাদের কর্মী-সমর্থকদের ৪০টি বাড়িতে ভাঙচুর করে আগুন লাগানো হয়েছে।”
মাদারবক্সের মাথায় বোমা লাগার কিছু ক্ষণের মধ্যেই গোলমাল ছড়ায় গ্রামে। শুরু হয় বোমা-গুলি। কিছু বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। সাড়ে ১০টা নাগাদ গ্রামে আসেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিলাদ্রিশেখর চক্রবর্তী। পুকুর থেকে দু’টি ভোটবাক্স উদ্ধার হয়। একটি বাক্সের হদিস মেলেনি। জেলা প্রশাসন থেকে পরে জানানো হয়, ওই বুথে ভোটগ্রহণ বাতিল। গোলমাল কিন্তু থামেনি। বরং আরও বাড়তে থাকে। আমডাঙার ওসি সামশের আলির নেতৃত্বে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি গ্রামে ঢোকে। সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের গাড়িও ছিল। গাড়িগুলি চার দিক থেকে ঘিরে শুরু হয় বোমাবাজি। ওসি-সহ দুই পুলিশ কর্মী জখম হন। পুলিশ তখন কার্যত পালানোর পথ পাচ্ছে না।
পরিস্থিতি বেসামাল দেখে বেলা ৩টে নাগাদ টেঙাটেঙি পঞ্চায়েত অফিস থেকে কিছুটা দূরে সন্তোষপুর মোড়, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সংযোগস্থলে জড়ো হয় পুলিশ, কমব্যাট ফোর্স, কেন্দ্রীয় বাহিনী। নেতৃত্বে এসপি সুগত সেন। বাহিনী গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের উপরেও হামলা হয়। কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে আমডাঙা থানায় ফিরে যান পুলিশকর্তারা। তখনও বোমা-গুলির লড়াই চলছে।
পুলিশ গ্রামে ঢোকার চেষ্টা না-চালিয়ে ফিরে গেল কেন, তার জবাব দেননি এসপি। রাতে তিনি শুধু বলেন, “গ্রামের ভিতরে সংঘর্ষে এক জন মারা গিয়েছেন। পুলিশকে লক্ষ করে গুলি চালানো হয়েছে। কেউ কেউ আহত হয়েছেন। ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
রাজ্য নির্বাচন কমিশন অবশ্য এই ঘটনায় জেলা প্রশাসনকেই অভিযুক্ত করেছে। কমিশনের সচিব তাপস রায়ের দাবি, “বুথের ভিতরে ও ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কমিশনের। তার বাইরের দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের।” কমিশনের এক কর্তার মতে, জেলা প্রশাসনের কর্তারা বৃহস্পতিবারের পর থেকেই সক্রিয় হলে আমডাঙার ঘটনা ঠেকানো যেত।
কারণ, আমডাঙার এই এলাকা যে উত্তপ্ত হতে পারে বৃহস্পতিবারই আঁচ মিলেছিল বইচগাছির ঘটনায়। সেখানে বুথের একাংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ওই বুথে অবশ্য ভোট হয়েছে। পাশেই কুলডাঙার একটি বুথে বেলা ১১টার মধ্যে ৬৪২ জন ভোটারেরই ভোট পড়ে। ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ওঠায় ওই বুথে পুনর্নির্বাচনের কথা জানায় প্রশাসন ।
|
(সহ প্রতিবেদন: অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়)
|