অনুব্রতর হুমকির পরেই হামলা শুরু: রণক্ষেত্র আমডাঙা
গুলি-বোমার লক্ষ্য পুলিশ, জখম ওসি
ঙ্গলবার উত্তপ্ত ছিল দক্ষিণ। বুধবার রাতে গরম উত্তর ২৪ পরগনাও। তার জেরেই বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এই জেলার আমডাঙায় দফায় দফায় সংঘর্ষ চলল সিপিএম-তৃণমূলের মধ্যে। শ’তিনেক বাড়ি-দোকান ভাঙচুর চলে। আগুন লাগানো হল বেশ কিছু ক্ষেত্রে। এবং দু’দলের মধ্যে পড়ে বেধড়ক মার খেল পুলিশ। তাদের গাড়ি লক্ষ করে ছুটে এল বোমা-গুলি। ইঞ্জিন খুলে ফেলে দেওয়া হল পাশের পুকুরে। ছিনতাই করা হয় লাঠি, মোবাইল। আধপোড়া গাড়িতে ইট দিয়ে ঘষে লিখে দেওয়া হয় রাজনৈতিক দলের নাম। ঘটনায় জখম হলেন ওসি-সহ বেশ কয়েক জন পুলিশকর্মী। মোট জখমের সংখ্যা কমপক্ষে ২৫।
ঘটনাচক্রে, বুধবারই বীরভূমে এক জনসভায় দুই মন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল দলের কর্মীদের পরামর্শ দেন, প্রয়োজনে তাঁরা যেন পুলিশের গাড়িতে বোমা মারতেও দ্বিধা না করেন। বিরোধিতার সম্মুখীন হলে প্রার্থীর বাড়িতে গিয়ে হামলা করার কথাও বলেন তিনি। বৃহস্পতিবার আমডাঙার বইচগাছির কুলডাঙায় পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার পিছনে সেই ‘ডাক’ কাজ করেছে কিনা, এখন সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
আমডাঙায় পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর।
বিরোধীরা বলছেন, অনুব্রতর হুমকির জেরেই পুলিশকে নিশানা করেছে তৃণমূল। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, সিপিএমই প্রথম আক্রমণ করে।
শুধু পুলিশই নয়, উন্মত্ত জনতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের গাড়ি, সাংবাদিকদের মোটরবাইক। পর্যবেক্ষকদের গাড়ির সামনে বোমা পড়ে। আগুন ধরিয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয় সাংবাদিকের মোটরবাইক। পুকুরে ভাসতে দেখা গেল বহু আসবাব, আলমারি, টিভি, রেফ্রিজারেটর। গ্রামের নির্বাচনী বুথ হয়েছিল যে স্কুলে, তার একটি ঘরও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয় রাজনৈতিক চাপানউতোর।
যাবতীয় দায় সিপিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে বৃহস্পতিবার কোচবিহারের দেওয়ানহাটে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমডাঙায় সিপিএম আক্রমণ করেছে। পুলিশকে বোমা মেরেছে। গাড়ি জ্বালিয়েছে। মানুষ যাতে সুষ্ঠ ভাবে ভোট দিতে না পারে সেই জন্যই গণ্ডগোল করা হচ্ছে।” অন্য দিকে, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “গৌতম দেবের প্ররোচনায় আমডাঙার ঘটনা ঘটেছে। আমাদের দলের কর্মী-সমর্থক ও পুলিশের উপরে ওরাই হামলা চালিয়েছে।”
বাড়ির দেওয়ালে বোমার দাগ।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব বলেন, “জ্যোতিপ্রিয়র কথার জবাব দিতে আমার রুচিতে বাধে।” তিনি জানান, সিপিএমের প্রতিনিধিদল আমডাঙার গ্রামে গিয়েছিল। তাঁরাই যা বলার বলবেন। ওই প্রতিনিধিদলে ছিলেন নেপালদেব ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানস মুখোপাধ্যায়। পরে শুধু অনুব্রত নন, জ্যোতিপ্রিয়র দিকেও পরোক্ষে আঙুল তুলে নেপালবাবু বলেন, “এক জন বলছেন সাপের মতো পিটিয়ে মার। এক জন বলছেন আশঁবটি নিয়ে তৈরি থাক। এক জন বলছে পুলিশ দেখলেই গুলি-বোমা ছোড়ো। তার পরেও যদি গৌতম দেবের মতো বাম নেতাদের দোষ দেন, তা হলে তাঁদের নির্লজ্জ ছাড়া মানুষ কী বলবে?”
প্রশ্ন উঠেছে, এত কিছু করে যেখানে ভোটের সময়ে শান্তিরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী আনা হয়েছে, সেখানে ভোটের এক বা দু’দিন আগে এমন সব ঘটনা ঘটে কী করে? পুলিশ-প্রশাসন থেকে এর সরাসরি কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। পরে জেলা পুলিশ সুপার সুগত সেন জানিয়েছেন, ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী এলাকায় রুটমার্চ করছে। জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল জানিয়েছেন, ভোটকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেখানে ভোট নেওয়া সম্ভব। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের গাড়ির সামনে বোমা ফাটলেও তা পর্যবেক্ষকের গাড়ি লক্ষ করে ছোড়া হয়নি বলেই তাঁর দাবি।
এত বড় গোলমাল কেন ছড়াল? আমডাঙার তারাবেড়িয়া পঞ্চায়েতটি তৃণমূলের দখলে। ক’দিন ধরেই উত্তেজনা দানা বাঁধছিল। সিপিএমের দাবি, তাদের কর্মী-সমর্থকদের ভোটের দিন বুথের ধারেকাছে না ঘেঁষার জন্য হুমকি দিচ্ছিল শাসকদলের লোকজন। বুধবার রাতে দু’পক্ষের বচসা-হাতাহাতিও হয়।
পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে আসবাবপত্র ও মোটরবাইক।
ওই এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা কুলডাঙা রোডের এক ধারে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি। উল্টো দিকের বাসিন্দারা বেশির ভাগই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক। অভিযোগ, বুধবার রাতে এলাকা উত্তপ্ত হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে দু’পক্ষের মধ্যে মারপিট শুরু হয়। সিপিএমের অভিযোগ, তৃণমূলের প্রায় শ’তিনেক সশস্ত্র লোক বাড়ি বাড়ি ঢুকে ভাঙচুর, মারধর শুরু করে। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, সিপিএমের শ’দুয়েক লোকই প্রথমে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে। দু’পক্ষেরই দাবি, বহু বহিরাগত সশস্ত্র লোকজন ঢুকেছিল গ্রামে।
সিপিএম সমর্থক আসিরা বিবি, ফতিমা খাতুনেরা বলেন, “ওরা মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ফাটাচ্ছিল। গুলিও ছুড়ছিল। যাকে সামনে পাচ্ছিল, তাকেই পেটাচ্ছিল। ছোট বাচ্চা, মহিলা কাউকে বাদ দেয়নি। নির্বিচারে শ্লীলতাহানিও করেছে।” মোহরজান বিবির কথায়, “আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিল। আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়েই মারত। আমি দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচেছি।” তাঁদের আরও দাবি, গনি পেয়াদা নামে বছর আঠারোর এক তরুণ ঘুমিয়েছিলেন। দুষ্কৃতীরা ঘরে ঢুকে অস্ত্রের আঘাতে তাঁর মাথা ফাটায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় গনিকে ভর্তি করা হয়েছে বারাসত জেলা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা চলছে পুলিশ কর্মী-সহ দু’পক্ষের জখমদের। নূর ইসলাম নামে সিপিএম সমর্থক এক প্রতিবন্ধী যুবক বলেন, “বহু কষ্টে দোকান করে সংসার চালাচ্ছিলাম। সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। দোকানের মালপত্র ফেলে দিয়েছে জলে।” সিপিএমের দাবি, তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রার্থী রেজ্জাক হালদারের নেতৃত্বে হামলা চলেছে।
উল্টো দিকে আবার তৃণমূলের অভিযোগ, খোদ রেজ্জাকের বাড়িতেই ভাঙচুর হয়েছে। তিনি তা হলে হামলায় নেতৃত্ব দিলেন কী ভাবে? স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক রফিকুর রহমান বলেন, “সিপিএমের লোকজনই প্রথম হামলা চালায়। তাদের হাতে বোমা-পিস্তল তো বটেই, স্টেনগানও ছিল। হাজার দু’য়েক বোমা ছোড়া হয়েছে। আমাদের তিনশোরও বেশি বাড়ি ভাঙচুর করেছে।” তৃণমূল প্রার্থী রেজ্জাকের বউমা নাজিমা বিবি বলেন, “শ’দুয়েক তৃণমূলের লোক গ্রামে ঢুকে কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালাল। পুলিশ সব কিছু দেখেও বাধা দেয়নি।” তৃণমূল সমর্থক উজ্জ্বলা বিবি বলেন, “ওরা বাচ্চাদেরও রেয়াত করেনি। নিয়ামত আলি নামে এক বালককে সামনে পেয়ে কুপিয়েছে।”
সংঘর্ষের খবর পেয়ে বেলা ৮টা নাগাদ আমডাঙার পুলিশ গিয়েছিল গ্রামে। কিন্তু বোমা-গুলির সামনে ফিরে যেতে হয় তাঁদের। পরের দফায় এসডিপিও (বারাসত) সুবীর চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আরও বাহিনী গিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। উল্টে ইটের ঘায়ে জখম হন আমডাঙার ওসি সামশের আলি। কয়েক জন পুলিশকর্মীর (তাঁদের মধ্যে মহিলা কর্মীও ছিলেন) হাত থেকে লাঠি, মানিব্যাগ, মোবাইল কেড়ে পুকুরে ফেলে দেয় হামলাকারীরা। বড়গাছিয়া অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুলে ভোটকেন্দ্র হয়েছে। স্কুলের পাশের একটি ঘরের দেওয়াল ভেঙে দিয়েছে হামলাকারীরা। ভোটের সরঞ্জাম তছনছ করা হয়।
বেলা ১২টার পরে র‌্যাফ, কমব্যাট ফোর্স, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা গিয়ে লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনেন। লাঠির ঘায়ে কয়েক জন জখম হয়েছেন বলে দাবি সিপিএম-তৃণমূলের।

ছবি: সুদীপ ঘোষ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.