ছবিটা পাল্টায়নি। পাল্টেছে শুধু রং আর চরিত্র।
এক সময়ে যত দূর চোখ যেত, নজরে পড়ত শুধুই লাল পতাকা। পতাকা এখনও উড়ছে, তবে রং পাল্টে এখন তাতে ঝলমল করছে ঘাসফুল। পঞ্চায়েত ভোটের দিন রাজারহাটের মহিষবাথান ২ পঞ্চায়েতে দেখা গেল এমন দৃশ্যই।
ছাপ্পা, বহিরাগতদের এনে সন্ত্রাস, ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ আগেও উঠত। আঙুল ছিল সিপিএমের দিকে। সে সব অভিযোগ এ বারও উঠেছে। তিরটা শুধু ঘুরে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই উত্তপ্ত হচ্ছিল মহিষবাথান ২ পঞ্চায়েত এলাকা। বামেদের অভিযোগ, প্রার্থীরা সকলেই তৃণমূলের সন্ত্রাসে ঘরছাড়া। এ দিন সকালে ভোট শুরু হতেই নানা বুথে উত্তেজনা ছড়ায়। যেমন, তারুলিয়ার চঞ্চলকুমারী বিদ্যালয়ের বুথ। সেখানে বুথের সামনে ছিলেন হরিয়ানা থেকে আসা জওয়ানেরা। তাঁদের কয়েক জন ছিলেন ভোটকেন্দ্রের আশপাশে নজরদারিতেও। কিন্তু কিছুটা দূরে গেলেই ছবিটা আলাদা। নানা গলির মোড়ে শাসকদলের বিভিন্ন বাহিনীর পিকেটিং। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রার্থী সিপিএমের বিনতা পাত্রের অভিযোগ, “সকাল ৭টার আগে গলিতেই আমাকে আটকে দিল। কোনও মতে অন্য পথে গিয়ে ভোট দিতে পারি। কিন্তু ভোটার স্লিপ কেড়ে নিয়ে তৃণমূলের বাহিনী আমার স্বামীকে জানাল, ভোট পড়ে গিয়েছে।”
এই পঞ্চায়েতের তারুলিয়া থেকে মহিষগোট, থাকদাড়ি, বৈদ্যপাড়াকার্যত কোনও বুথেই সিপিএমের কোনও এজেন্টকে চোখে পড়েনি। এলাকাছাড়া এক পঞ্চায়েত প্রার্থী সিপিএমের তাপস মাঝির দাবি, “প্রার্থীরাই ভোট দিতে পারছে না। সমর্থক ও সাধারণ মানুষ কী করে ভোট দেবে?” এলাকার পরিবেশ থমথমে। তবে একটি বুথের পাশে নির্মীয়মাণ বাড়িতে দেখা গেল, রীতিমতো শিবির করেছে শাসক দল। থাকদাড়ির বৈদ্যপাড়ায় ম্যারাপ বেঁধে রান্নাবান্না চলছে। টেবিল-চেয়ার পেতে হচ্ছে খাওয়াদাওয়াও। মেনুতে ডাল, মুরগির মাংস, চিংড়ি, চাটনি।
বামেদের অভিযোগ, দিনভরই এলাকা সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল তৃণমূল। জেলা পরিষদের সিপিএম প্রার্থী পরিমল মিস্ত্রির বক্তব্য, “সব প্রার্থীই এলাকাছাড়া। এজেন্টদের জোর করে বের করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ জানিয়েছি। আমি দু’বারের চেষ্টায় ভোট দিতে পেরেছি।” ভয় যে একটা রয়েছে, বোঝা গেল বুথের পথে এক ভোটারের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বলেই ফেললেন, “দয়া করে ছবি তুলবেন না। আপনারা চলে গেলে কী হবে?”
বিকেলে থাকদাড়ির অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথ উত্তপ্ত হয়। বুথের ২০০ মিটারের মধ্যে রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত, সল্টলেক পুরসভার কাউন্সিলর স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ প্রায় দু’শো কর্মী জড়ো হন। বুথে থাকা জওয়ানেরাও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। কমান্ড্যান্ট ডি কে ভরদ্বাজ অতিরিক্ত বাহিনী নিয়ে গেলে শাসকদলের কর্মীদের সঙ্গে রীতিমতো ধস্তাধস্তি হয়। বিধায়কের যুক্তি, “এক বৃদ্ধাকে বুথ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় বাসিন্দারা ক্ষেপে যান। তা নিয়েই গোলমাল। জওয়ানদের সঙ্গে ভাষাগত সমস্যা হয়েছিল।” সিপিএম নেতা রবিন মণ্ডলের অভিযোগ, “মহিষবাথানে সন্ত্রাস ছড়িয়ে ভোট হল। বিধায়ক বহিরাগতদের নিয়ে কার্যত অধিকাংশ বুথই দখল করল। মহিলা প্রার্থী থেকে ভোটার, কাউকে ভোট দিতে দেওয়া হল না।”
রাজারহাটের ছ’টি পঞ্চায়েত এলাকাতেই সব্যসাচীবাবু, সল্টলেক ও দক্ষিণ দমদম পুরসভার একাধিক কাউন্সিলর শ’দুয়েক কর্মী-সমর্থককে নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান বলে বামেদের অভিযোগ। বহিরাগত হওয়া সত্ত্বেও কেন রাজারহাটে গেলেন, সে প্রশ্নে সব্যসাচীবাবু জানান, অনুমতি নিয়েই রাজারহাটে গিয়েছিলেন। মহিষবাথান ২ ছাড়া পাঁচটি পঞ্চায়েতে অবশ্য পরিস্থিতি তুলনায় স্বাভাবিক ছিল। রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার চেয়ারম্যান সিপিএমের তাপস চ্যাটার্জি বলেন, “বিধায়কের নেতৃত্বে তৃণমূলের বাহিনী দিনভর সন্ত্রাস করল। প্রশাসন নির্বিকার।”
সব অভিযোগ অস্বীকার করে রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের সাফ বক্তব্য, “মানুষ উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন। বিরোধীদের পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়াতেই ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে। মহিষবাথানে এই প্রথম শান্তিপূর্ণ ভাবে মানুষ ভোট দিতে পারলেন।”
এ দিন রাত পর্যন্ত ভোট হয় রাজারহাটের বেশ কিছু বুথে। চাঁদপুর পঞ্চায়েতে পানাপুকুর বুথে, রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের নবাবপুর ও কাজিয়াপাড়ায় রাত ১০টাতেও ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা গিয়েছে।
|