বাম জমানায় শরিকি দ্বন্দ্বেও এমন ‘বেনজির’ অশান্তি কোনও দিন দেখেননি কসবা পঞ্চায়েত এলাকার মানুষজন। কিন্তু শাসকদল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত নাভিশ্বাস উঠেছে বাসিন্দাদের। প্রাণ হাতে নিয়ে নিরুপায় বাসিন্দারা ‘কালাতিপাত’ করছেন এমনটাই দাবি বামফ্রন্ট থেকে শাসকদলের একাংশের।
প্রসঙ্গত, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন কারণে এই জেলায় রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে যেমন বাক্ বিনিময় হয়েছে, তেমনি সংঘর্ষও হয়েছে কোনও কোনও সময়। ‘ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতাহীন দল’ নামে দুই শিবিরে কার্যত ভাগ হয় তৃণমূল। বোলপুরের প্রাক্তন বিধায়ক, আরএসপির তপন হোড় বলেন, “১৯৭৮ থেকে আমদের দলের দখলে ছিল ওই এলাকা। তবে আমাদের (বামফ্রন্ট) মধ্যে যে, অনেক সময় ঐক্যমত হত না, তা অস্বীকার করছি না। এমনও দিন গিয়েছে। রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদেরকে বামফ্রন্টের শরিক সিপিএমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। তাই বলে এলাকায় এমন অশান্তি কোনও দিন হয়নি।” মতের অমিল থাকতেই পারে। তবে প্রাণ হাতে নিয়ে বাসিন্দারা জীবন নির্বাহ করনেননি বলে দাবি তপনবাবুর।
কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে গোপালনগর সংসদ থেকে জয়ী হয়েছিলেন আরএসপির বামাচরণ সামন্ত। হেরেছিলেন সিপিএম প্রার্থী অতুল ঘোষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নির্বাচনের পর এমনকী গত কয়েক বছর কোনও অশান্তি ছিল না ওই এলাকায়। এলাকার সুবিধে-অসুবিধেতে সকল মিলে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু এমন হাল কোনও দিন দেখেননি তাঁরা। শরিকি দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সিপিএমের বোলপুর জোনাল সম্পাদক উৎপল রুদ্র। তিনি বলেন, “নির্বাচনে আমরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি বাম-শরিকের বিরুদ্ধে। সব সময় যে মতের মিল হত, তা আমি বলব না। কিন্তু রোজ গণ্ডগোল, হামলা হচ্ছে। এমন অশান্তি ছিল না।” উৎপলবাবু আরও যোগ করেন, “বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পুরছে। বিরোধী প্রার্থীদেরকে মারধর, অপহরণ, ঘরে অগ্নিসংযোগ লেগেই আছে। প্রকাশ্যে বোমা মারার হুমকি, এমনকী পুলিশ প্রশাসনও রেহাই পাচ্ছে না। এর প্রতিবাদে আমরা নির্বাচন কমিশনে জানাব।”
স্থানীয় বাসিন্দা শঙ্কর পাল, নিধিরাম ঘোষ থেকে শুরু করে স্কুল পডুয়া শম্পা দাস, গৃহবধূ কাকলি সর্দাররা বলেন, “বছর দু’য়েক ধরে এলাকায় এমন অশান্তি যে, থাকা যায় না। বাড়ির বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। একই দলের দুই গোষ্ঠীর ঝামেলা, তার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। কারও ওপর আস্থা নেই। ভরসাও করতে পারছি না।”
প্রতি নিয়ত যে অশান্তি, নিত্য ঝামেলা, সন্ত্রাস, পাল্টা হামলা ক্রমাগত বাড়ছে তা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন শাসকদলের যুযুধান দুই গোষ্ঠী। তার পরেও একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে এক রকম দায়িত্ব থেকে নিস্তার নেওয়ার চেষ্টা চালাছেন। সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক তথা পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী জেলা সভাপতির ‘ঘনিষ্ঠ’ শেখ মুস্তফার দাবি, “আসলে ওরা এলাকায় তোলাবাজি করছে সন্ত্রাস করছে। আমরা পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি।” অন্য গোষ্ঠী অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ওই এলাকায় নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হৃদয় ঘোষ ও অঞ্চল সভাপতি নিখিল পাল বলেন, “এলাকায় কারা তোলাবাজি করে, কারা সন্ত্রাস করে মানুষ জানেন। তৃণমূলের নামে এ সব চলছে। আমরা প্রতিবাদ করতে গিয়েই রোষের মুখে পড়ছি।”
প্রসঙ্গত, বুধবার পাড়ুই থানার কসবা বাসস্ট্যান্ডে তৃণমূলের সভা থেকে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল কর্মীদের উদ্দেশে বলে দিয়েছেন, কোনও নির্দল প্রার্থী হুমকি দিলে তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দিন। উস্কানিমূলক এই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরেই ওই পঞ্চায়েতেরই নির্দল প্রার্থী (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) রবিলাল সরেনের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। অপহরণের অভিযোগ ওঠে। আরও কিছু নির্দল প্রার্থীর বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। ৩৬ ঘণ্টা পরেও খোঁজ নেই রবিলালবাবুর। বাড়তি গণ্ডগোলের আশঙ্কায় পুলিশ টহলদারি বাড়িয়েছে। কসবা পঞ্চায়েত এলাকায় বহু বাড়ি পুরুষ শূন্য। বোলপুরের এসডিপিও প্রশান্ত চৌধুরী বলেন, “কসবায় একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। তবে এই ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেফতার হইনি। তদন্ত চলছে।
|