জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে শুক্রবার রাতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠালেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। এ দিনই বীরভূমে দু’টি সভা
করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু অনুব্রতবাবুর সঙ্গে আগাগোড়াই দূরত্ব বজায় রেখে চলেন তিনি।
দু’টি সভার একটিতেও মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সভামঞ্চে কার্যত দেখা যায়নি অনুব্রতবাবুকে।
বুধবার বোলপুরের কসবা পঞ্চায়েত এলাকার এক সভায় দলীয় কর্মীদের অনুব্রতবাবু বলেছিলেন, কোনও নির্দল প্রার্থী হুমকি দিলে তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে। কোনও নির্দলকে পুলিশ সমর্থন করলে পুলিশকে বোমা মারতেও বলেছিলেন তিনি। তার পরের দিনই কমিশনের সচিব তাপস রায় মুখ্যসচিবকে চিঠি দিয়ে বলেন, অনুব্রতবাবুর বক্তব্য প্ররোচনামূলক। তাঁর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। চিঠিতে এ-ও বলে দেওয়া হয়েছিল, শুক্রবারের মধ্যেই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ কমিশনকে জানাতে হবে। সেই চিঠির উত্তরেই এ দিন মুখ্যসচিব লিখেছেন, বীরভূমের পুলিশ সুপারকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি। পুলিশ সুপার সেই মতো পদক্ষেপ করবেন।
কমিশনের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, মুখ্যসচিব লিখিত ভাবে জানালেও জেলা প্রশাসন অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা নজরে রাখা হচ্ছে। তারা কোনও রকম শিথিলতা দেখালে কমিশনই কড়া ব্যবস্থা নেবে।
অনুব্রতবাবুর মন্তব্য নিয়ে এ দিন বিরক্তি প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। এ নিয়ে কোনও আলোচনা করাই অর্থহীন!” |
পঞ্চায়েত ভোট শুরুর আগেও এক বার উস্কানিমূলক মন্তব্য করে পার পেয়ে গিয়েছিলেন অনুব্রতবাবু। রামপুরহাটের কর্মিসভায় তিনি বলেছিলেন, “বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেবেন না। দরকারে আমাকে ডাকবেন।” সে বারও জেলা প্রশাসনকে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু সেই নির্দেশ মানা হয়নি।
বুধবার পাড়ুই থানার কসবা পঞ্চায়েতের জনসভায় অনুব্রতবাবুর মন্তব্যের পরে এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একাধিক নির্দল (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) প্রার্থীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন লাগানোর অভিযোগ ওঠে। এমনকী এক প্রার্থীকে অপহরণও করা হয় বলে অভিযোগ। স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টি এ বার অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে।
বিতর্কের এই আবহের মধ্যেই শুক্রবার বীরভূমে ভোট প্রচারে যান মুখ্যমন্ত্রী। রামপুরহাট ও দুবরাজপুরের দু’টি জনসভা করেন তিনি। অনুব্রতবাবুকে ভর্ৎসনা করেননি ঠিকই, কিন্তু জেলা সভাপতি সম্পর্কে একটি শব্দ খরচ করেননি। দু’টি সভার মঞ্চেই মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দেখা যায়নি জেলা তৃণমূলের ‘শেষ কথা’ অনুব্রতবাবুকে।
বরং রামপুরহাট হাইস্কুলের মাঠে মঞ্চের দায়িত্ব নিতে দেখা গেল বীরভূম জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মুখ্যমন্ত্রীর দিকে মাইক্রোফোনও বাড়িয়ে দেন তিনিই। দলীয় রাজনীতিতে আশিসবাবু অনুব্রতবাবুর বিরোধী হিসেবেই পরিচিত। মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করেন ‘জেলা সভাপতি অনুব্রত, শ্রদ্ধেয় আশিসদা...’ বলে। ব্যস, ওইটুকুই। তার পর আর অনুব্রতবাবুর নাম মুখে আনেননি। মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ওঠার পরে মিনিটখানেক সেখানে ছিলেন জেলা সভাপতি। তার পরেই তিনি মঞ্চ ছাড়েন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় বক্তৃতা দেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুব্রতবাবুকে ধারেকাছেও দেখতে পাওয়া যায়নি। সভা শেষ হতে দলীয় কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, সভাপতি গেলেন কোথায়? মঞ্চে উপস্থিত নেতারা জানান, উনি দুবরাজপুরে গিয়েছেন। |
দুবরাজপুরের সভায় মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছন বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ। তার ঘণ্টাখানেক আগেই পৌঁছেছিলেন অনুব্রতবাবু। তিনি বক্তৃতা দেন। মমতা গাড়ি থেকে নামার পরে তাঁর সঙ্গে মঞ্চের সিঁড়ি অবধি যান জেলা সভাপতি। মমতা সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠে গেলেও নীচেই রয়ে যান অনুব্রবতবাবু। এখানেও মমতা যে এক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিয়েছেন, সেই সময়ে অনুব্রতবাবুকে দেখা গিয়েছে ভিড় সামলাতে, দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিতে, কখনও বা জেলার পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত থাকতে। মমতা চলে যাওয়ার সময় আবার তিনি গাড়ি অবধি যান।
এই ঘটনাকে অনুব্রতবাবুর মন্তব্য সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চলার ইঙ্গিত বলে দাবি করেন জেলা তৃণমূলের একাধিক নেতা। অনুব্রতবাবু অবশ্য দাবি করেন, “আমি কোনও দিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্চে থাকি না। তাঁকে ‘রিসিভ’ করার পরে চলে যাই।” এর কিছু পরেই জানা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা কমিশনকে জানিয়েছেন মুখ্যসচিব।
হুমকি দেওয়ার ধারা অবশ্য জারি রেখেছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসের’ প্রতিবাদে এ দিন ডানলপে সিপিএম পথ অবরোধ করেছিল। সেই প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা গৌতম দেবকে হুঁশিয়ারি দিয়ে পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “সাত দিন অপেক্ষা করুন। অবরোধ হবে আপনার বাড়ির রাস্তায়। বাড়িতে ঢুকতে পারবেন না। এ বারের পুজো আপনি টাকিতে দেখতে পারবেন না, বাংলাদেশে দেখতে হবে!” নিজে গিয়ে অবরোধ তুলেও দেন মদনবাবু। অনুব্রতবাবুর প্রসঙ্গে যিনি মহাকরণে বলেছিলেন, “মুখ ফস্কে কথা বেরিয়ে গিয়েছে বলে অনুব্রত স্বীকার করেছে। কিন্তু আগের মুখ্যমন্ত্রী মাথা ভেঙে দেব বলে হুঙ্কার দিতেন। এখন এত হইচই কেন?”
তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু শুক্রবার আলিপুরদুয়ারে বলেছিলেন, “এ ধরনের মন্তব্য করা ঠিক নয়। বাকসংযম থাকা উচিত।” আর বীরভূমে মুখ্যমন্ত্রীর সভা শেষের পর নিচুতলার কর্মীরা বলছেন, “প্রকাশ্যে কিছু না বলে অনেক কিছু বলে গেলেন আমাদের দলনেত্রীও!”
|
(সহ প্রতিবেদন: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়, দয়াল সেনগুপ্ত)
শুক্রবার দয়াল সেনগুপ্তের তোলা ছবি।
|